জামিয়ার শিক্ষা কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
মুফতি আশরাফুজ্জামান
জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া দেশের কওমি মাদরাসাসমূহের মধ্যে অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী একটি প্রতিষ্ঠান। দারুল উলুম দেওবন্দের আদর্শ, আকাবির-আসলাফের চেতনাই এর প্রাণ। উপমাহাদেশের অন্যতম হাদীসবিশারদ, বহুমুখী বাক্তিত্বের অধিকারী শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) এর দ্বীনি উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং সুচিন্তিত ইলমী ফিকির ও ভাবধারাকে সম্বল করে শাইখের সুযোগ্য উত্তরসূরিগণ এ প্রতিষ্ঠানটিকে ‘আজিজি চেতনায়’ রাঙিয়ে তুলেছেন। সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য এ প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে বহুমুখী শিক্ষাকার্যক্রম ও সুচিন্তিত তারবিয়তি আয়োজন এবং উপযোগী পরিবেশ। শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দের মাদরাসা এটি। অভিভাবকবৃন্দ তার সন্তানকে জামিয়ায় ভর্তি করার সুযোগকে নেয়ামত মনে করে থাকেন। মেধাবী তো বটেই, দুর্বলমেধার শিক্ষার্থীরাও যোগ্য আলেম, কর্মঠ ও দক্ষ দায়ী, জ্বীন ও ইসলামের নিবেদিতপ্রাণ মুজাহিদ হিসেবে গড়ে ওঠে। জামিয়ার ফারেগীন উলামায়ে কেরাম কর্মজীবনে ভিন্ন উচ্চতায় অবস্থান করে থাকে। শিক্ষকতা, বয়ান-বক্তৃতা, ওয়াজ ও তাফসীর, সাহিত্য ও প্রকাশনা, দাওয়াত ও তালিম, ইসলামের পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রামের মিছিলে তারা থাকে নেতৃত্বের সারিতে। আর এটা সম্ভব হয় জামিয়ার শিক্ষাকার্যক্রম সুবিন্যস্ত ও ছাত্রদের জীবন গড়ার কর্মপদ্ধতি নিপুণ ও সুপরিকল্পিত হওয়ার কারণেই।
ছাত্র ভর্তি কার্যক্রম
জামিয়ার শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় আরবি শাওয়াল মাসের আট তারিখ থেকে। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর একদিনেই সার্বিক বিবেচনায় ভর্তি উপযুক্ত পুরাতন ছাত্রদের ভর্তি কার্যক্রম শেষ হয়। এর পরবর্তী এক বা দুই দিনের মধ্যে নতুন ছাত্রদের ভর্তি সমাপ্ত হয়ে যায়। নতুন ছাত্রদের ভর্তির ক্ষেত্রে কিতাবি যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য ভর্তি ভর্তি পরীক্ষা হয় অতি গুরুত্বসহকারে। ভর্তি পরীক্ষাকে সম্পূর্ণ চাপ ও সুপারিশমুক্ত রাখা নিশ্চিত করা হয়। কর্তৃপক্ষ, দায়িত্বশীল বা অভিভাবকবৃন্দ কেউ যেন কোনো প্রকার প্রভাব প্রয়োগ করতে না পারে- সর্বসম্মতিক্রমে তার ব্যবস্থা করা হয়। ভর্তি কার্যক্রম শেষে নিয়মিত দরস শুরু হওয়াই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া নেজাম, শৃঙ্খলাকে পড়ালেখার সমান গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। তাই ভর্তি কার্যক্রম শেষ হওয়ার এপর সবক ইফতিতাহের পূর্বেই শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক কাজগুলো অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আঞ্জাম দিয়ে থাকে। আবাসিক ছাত্রদের সিট বণ্টন, গরিব ও এতিম ছাত্রদের ফ্রি খানা ও কিতাবের ব্যবস্থাপনা, আগত বছরটি কীভাবে কাটালে প্রতিটি শিক্ষার্থী ইলম ও আমলের উন্নতি সাধন করতে পারবে তার দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়। বিশেষভাবে সকল উস্তাদদের উপস্থিতিতে জামিয়ার নিয়ম-কানুন শোনানোর মজলিস অনুষ্ঠিত হয় যা প্রতিটি ছাত্রের মননে দারুণ প্রভাব ফেলে। এ কার্যক্রমগুলো গোটা বছর পথচলার প্রেরণা ও গাইড হিসেবে কাজ করে।
জামিয়ার বিভাগসমূহ
আমাদের এ বিভাগটি সতন্ত্র পরিবেশে পর্যাপ্ত দক্ষ শিক্ষকের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। শিক্ষকগণ রাত-দিন ছাত্রদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। পড়াশোনা থেকে নিয়ে তাদের খাওয়া-দাওয়া, অজু-গোসল, ঘুম, খেলাধুলাসহ সকল বিষয় পর্যবেক্ষণ করেন। নামাজ, দুআ-কালাম ও সকল কাজের সুন্নত তরিকা হাতে-কলমে শিক্ষা প্রদান করেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রাখার জন্য রয়েছে নির্ধারিত পরিচ্ছন্নকর্মী। পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার সাথে সাথে ছাত্রদের অসুখবিসুখে তাদের যত্ন নেওয়ার কাজেও নিয়োজিত থাকে তারা। এ বিভাগে মাত্র দুই বছরে নূরানী পদ্ধতিতে সহিহ-শুদ্ধরূপে পবিত্র কুরআনুল কারিমের তেলাওয়াত, নির্বাচিত সুরাসমুহ মুখস্থকরণসহ ৪০টি হাদীস মুখস্থ করানো হয়। অত্যাবশ্যকীয় মাসআলা-মাসায়েলসহ। ায়েলসহ দ্বিতীয় শ্রেণি বা সমমানের বাংলা, অংক, ঈ.রেজি ও সাধারণ শিক্ষা দেওয়া হয়।
হিফজ বিভাগ
একদল যোগ্য, একনিষ্ঠ হাফেজে কুরআনের মাধ্যমে পরিচালিত এ বিভাগে নাজেরা থেকে উত্তীর্ণদের অতি অল্প সময়ে তারতিলের সাথে কুরআনে কারিম হিফজ করানো হয়। প্রতিজন শিক্ষক সর্বোচ্চ ১৮ থেকে ২০ জন ছাত্রের দায়িত্বশীল হন। স্নেহ, মায়া-মমতার মাধ্যমে প্রতিটি ছাত্রকে অতি অল্প সময়ে কুরআনে কারিমের হিফজ সম্পন্ন করার জন্য অভিনব ও আধুনিক কলাকৌশল অবলম্বন করেন তাঁরা। জামিয়ার পক্ষ থেকেও তাদেরকে সুন্দর পরিবেশ দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত কাজ সম্পাদন করা ও সময়কে কাজে লাগানোর জন্য জন্যও রয়েছে নির্ধারিত সময় যার ব্যতিক্র করার কোনও সুযোগ নেই। ইয়াদ ও সহিহ-শুদ্ধ তেলাওয়াতের সাথে রয়েছে পরিকল্পিত রুটিন। সে রুটিন অনুযায়ী অতিবাহিত হয় তাদের দিন-রাত। অভিভাবকবৃন্দের সাক্ষাতের সাথে সুন্দর লাহানের প্রতিও বিশেষ। যত্ন নেওয়া হয় আর এর জন্য ভিন্নভাবে মশক করানো ও আন্তর্জাতিক মানের হাফেজ ও কারীদের তেলাওয়াত শোনার সুব্যবস্থা রয়েছে। তবে ছাত্ররা যেন প্রতিযোগিতামুখী হয়ে হিফজের পরে হক্কানী আলেম হওয়ার আগ্রহ হারিয়ে না ফেলে, সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি আমল-আখলাক, উন্নত চরিত্র ও সঠিক চিন্তা-চেতনা সৃষ্টির জন্য তারবিয়তি আলোচনা অব্যাহত রাখা হয়। তাহাজ্জুদ, ইশরাক, আওয়াবিনসহ সুন্নত ও নফল নামাজে ইয়াদকৃত অংশ পড়ার জোর তাগিদ দেওয়া হয়।
কিতাব বিভাগ
এ বিভাগটিই জামিয়ার বৃহত্তর ও প্রধান বিভাগ। এ বিভাগে শ্রেণি ভিত্তিতে মাদরাসা শিক্ষার প্রথম শ্রেণি হতে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পর্যন্ত শিক্ষাদানের সুব্যবস্থা রয়েছে। নাহু, সরফ, ফিকহ, আদব, বালাগাত, ইতিহাস, সমাজ ও বিজ্ঞান থেকে আরম্ভ করে পর্যায়ক্রমে কুরআন ও হাদীসের সার্বিক জ্ঞান হাসিলের লক্ষ্যে কিতাব বিভাগকে ১১টি শিক্ষাবর্ষে বিন্যস্ত করা হয়েছে। প্রতি শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যসূচিতে আকাবির ও আসলাফের নেসাবের সাথে প্রয়োজনীয় সংযোজনও রয়েছে। ইবতেদায়ি আওয়াল (প্রথম শ্রেণি) থেকে কাফিয়া জামাত পর্যন্ত দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সমমানের বাংলা, অংক, ঈ.রেজি, সমাজ, ভূগোলও পড়ানো হয়। কুরআন ও হাদীস তথা দ্বীনি শিক্ষার মূল চেতনা পরিপন্থী ক্ষতি সাধনকারী কোনো কিছু সংযোজন না করতে আমরা যেমন অনড়, তেমনিভাবে কুরআন-হাদীসের শিক্ষাগ্রহণ ও প্রচারের ক্ষেত্রে সহায়ক প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করতেও আমাদের কোন দ্বিধা নেই।
ইফতা বিভাগ
এ বিভাগের মাধ্যমে দাওরায়ে হাদীসে ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ আলেমদেরকে দেশবরেণ্য মুফতিয়ানে কেরামের তত্ত্বাবধানে ফিকহ বিষয়ে পারদর্শী হিসেবে যুগসমস্যার সঠিক সমাধান প্রদানে যোগ্যতাসম্পন্ন মুফতি রূপে গড়ে তোলা হয়। পাশাপাশি সাধারণ ও ধর্মপ্রাণ মানুষদের দৈনন্দিন জিজ্ঞাসার দ্বীনি সমাধান মৌখিক ও লিখিত আকারে জামিয়ার এ বিভাগ থেকে প্রদান করা হয়।
কিতাব বিভাগের ১১ শ্রেণির সিলেবাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ:
এ বর্ষে চতুর্থ শ্রেণির বাংলা, অংক, ঈ.রেজি, সমাজ, ভূগোল, ইতিহাসসহ হাফেজ ছাত্রদের হিফজের দাওর ও হাফেজ নয়, এমন ছাত্রদের কেরাতের মশক ও নির্বাচিত সূরাসমূহ মুখস্থ করানো হয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ের উর্দু শিখানো হয় পাশাপাশি হাতের লেখা সুন্দর করার প্রতি বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাংলা-উর্দু বানান শুদ্ধ করার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। মাসায়েলের জন্য তালিমুল ইসলাম প্রথম খণ্ড থেকে ৩য় খণ্ড পড়ানো হয়।
পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, অংক, সমাজ, ভূগোল ও ইতিহাসসহ হাফেজ ছাত্রদের হিফজের দাওর ও হাফেজ নয়, এমন ছাত্রদের কেরাতের মশক ও নির্বাচিত সূরাসমূহ মুখস্থ করানো হয়। উর্দুভাষা চর্চার জন্য উর্দুতে রচিত কয়েকটি উর্দু কিতাব পড়ানো হয় এবং আরবির জন্য সহায়ক হিসেবে ফার্সি ব্যকরণ ও সাহিত্যের প্রাথমিক কিতাব পড়ানো হয়। মাসায়েলের জন্য তালিমুল ইসলামের ৪র্থ খণ্ড পড়ানো হয়।
আরবি ব্যাকরণ ও আরবি সাহিত্যের ক্লাস এ শ্রেণি থেকে শুরু হয়। এ শ্রেণির মূল বিষয়ও এই দুটি। এর জন্য ইলমুস সরফ, মিযান-মুনশাইব, এসো আবরি শিখি ও আরবি সফওয়াতুল মাসাদির পড়ানো হয়। ইসলামি ইতিহাস ও উর্দু সাহিত্যচর্চার জন্য তারিখুল ইসলাম (উর্দু), মাসআলা-মাসায়েলের কিতাব বেহেশতি যেওর, আখলাক শিক্ষা ও ফার্সি সাহিত্যের জন্য কারীমা, হেকায়েতে লতিফ, পান্দেনামা পড়ানো হয়। হিফজের দাওর বা কেরাতের মশক, আরবি হাতের লেখার মশক ও বানান শুদ্ধ করাসহ ৬ষ্ঠ শ্রেণির সাধারণ শিক্ষাও এ শ্রেণির সিলেবাসে ক।
উদ্ভাবি ব্যকরণ, সাহিত্যসহ ফিকহে ইসলামি, ফার্সিসাহিত্য, নবীজি সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর সিরাত ও সপ্তম আপির সাধারণ বিষয় এ শ্রেণির পাঠ্যসূচি। আরবি গ্রামার ও সাহিত্যকে এ শ্রেণির মূল বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়। এ বর্ষে নিম্নে বর্ণিত কিতাবগুলো পড়ানো হয়। নাহবেমীর, শরহু মিআতে আমেল, ইলমুস সরফ ৩য়-৪র্থ, রওযাতুল আদব, মা-লা-বুদ্ধা মিনহু, গুলিস্তা, সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া, আদাবুল মুতাআল্লিমিন।
এ বর্ষ থেকে পূর্ণভাবে আরবি মাধ্যম শুরু হয়। অধিকাংশ কিতাব আরবিতে রচিত। এ শ্রেণিতে আরবি ব্যকরণের বিশ্লেষণধর্মী কিতাব হেদায়েতুল্লাহ ও সরফের ইলমুস সিগাহ, মধ্যমানের আরবিসাহিত্য কালয়ুবি, ফিকহে ইসলামির নূরুল ইযাহ, ইসলামি ইতিহাসের কিতাব তারিখে মিল্লাত, প্রাথমিক মানের ইলমে মানতিক (যুক্তিবিদ্যা)-এর কিতাব তাইসীরুল মানতিক, নবীজি (সা.)-এর হাদীস ভাণ্ডার থেকে সহজ ও মুখস্থ করার মতো ছোট ছোট হাদীস সম্বলিত হাদীসের কিতাব যাদুত্বলিবীন পড়ানো হয়। আরও রয়েছে অষ্টম শ্রেণির বাংলা, ঈ.রেজি।
এই শিক্ষাবর্ষে কুরআনুল কারীমের সূরায়ে কাফ থেকে সূরা নাস পর্যন্ত তরজমা এবং প্রিয় নবী (সা.)- এর বিষয়ভিত্তিক হাদীসের কিতাব মিশকাতুল আছার থেকে একশত হাদীস পড়ানোর পাশাপাশি চল্লিশটি হাদীস মুখস্থ করানো হয়। ফিকহের কিতাব কুদুরীর কিতাবুল বুয়ু থেকে শেষ পর্যন্ত এবং উসূলে ফিকহের উসুলুশ শাশী এবং ইলমে নাহুর কাফিয়া, আরবী ভাষা ও সাহিত্যের নাফহাতুল আদাব ও মুআল্লিমুল ইনশা (১ম) পড়ানো হয়। আর ইসলামি ইতিহাসের তারিখে মিল্লাত থেকে খেলাফতে বনু উমাইয়া ও ঈ.রেজি সাহিত্য ও ব্যকরণ এ শিক্ষাবর্ষে সিলেবাসভুক্ত আছে। এ ছাড়াও আখলাক / চরিত্র গঠনের কিতাব তালীমুল মুতাআল্লিমও এ শিক্ষাবর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাব।
এই শিক্ষাবর্ষে সূরা ইউসুফ থেকে সূরা হুজরাত পর্যন্ত কুরআন তরজমা এবং হাদীসের কিতাব আলফিয়াতুল হাদীস থেকে ১৫০ টি বিষয়ভিত্তিক হাদীস অধ্যায়নের পাশাপাশি চল্লিশটি হাদীস মুখস্থ করানো হয়। আরবী সাহিত্যের নাফহাতুল আরব এবং মুআল্লিমুল ইনশা (২য় খন্ড) পড়ানো হয়। ফিকহের গুরুত্বপূর্ণ কিতাব কানযুদ দাকায়েক, উসূলে ফিকহের নুরুল আনওয়ার এর সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস অধ্যায় পড়ানো হয়। এবং ইলমে নাহুর বিশ্লেষণধর্মী কিতাব শরহে জামী থেকে বাহাসে ইসম এবং ইলমে বালাগাত (অলংকার শাস্ত্রের) দুরুসূল বালাগাত এবং ইলমে মানতেক (যুক্তিবিদ্যা) এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিতাব শরহে তাহযীব এই শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যসূচীতে রয়েছে।
এ বর্ষে পড়ানো হয় কুরআনুল কারিমের তরজমা, সুরা ফাতিহা থেকে সূরা কাহাফের পূর্ব পর্যন্ত মোট ১৫ পারা। ইলমে ফিকহের শরহে বেকায়া কায়া (পূর্ণ), উসুলে ফিকহের নুরুল আনওয়ার (কিতাবুল্লাহ পূর্ণ), আরবি সাহিত্যের মাকামাতে হারিরি ও আত্বতরিক ইলাল ইনশা (৩), অলংকার শাস্ত্রের বিশ্লেষণধর্মী কিতাব মুখতাসারুল মাআনি, ইলমূল ফারায়েজের সিরাজি।
এ বর্ষে কুরআনুল কারিমের পূর্ণ তাফসীর (সংক্ষিপ্ত), তাফসীরে জালালাইন (পূর্ণ), ইলমে ফিকহের উচ্চতর কিতাব হিদায়া ১ম ও ২য়, উচ্চমানের আরবি সাহিত্য, উসুলে তাফসীর, ইলমে আকায়েদ ও ইসলামি অর্থনীতি পড়ানো হয়।
এ বর্ষে হাদীসের কিতাব মিশকাতুল মাসাবিহ (পূর্ণ), ইলমে ফিকহের হিদায়া ৩য় ও ৪র্থ খণ্ড, ইলমে তাফসীরের বায়যাবি শরিফ, ইলমে আকায়েদের শরহে আকায়েদসহ বাতিল ফিরকাসমূহ ও দেওবন্দ আন্দোলনের ইতিহাস পড়ানো হয়।
এ বর্ষে হাদীসের প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য কুতুবে ছিত্তাসহ মোট ৯ টি কিতাব পড়ানো হয়। বুখারী শরীফ ১ম ও ২য়, মুসলিম শরিফ ১ম ও ২য়, তিরমিজি শরিফ ১ম ও ২য়, আবু দাউদ শরিফ ১ম ও ২য়, নাসায়ি শরিফ ১ম ও ২য়, ইবনে মাযাহ শরিফ, শরহে মাআনিল আসার, মুয়াত্তা ইমাম মালেক (রহ.) ও মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.)। তাকমীল বর্ষে মুলত হাদীসেরই কিতাব পড়ানো হয়। এজন্য এ ক্লাসকে দাওরায়ে হাদীসও বলা হয়। আমাদের শরিয়তে ইসলামিয়ায় মুআশারাত, আদাব ও আখলাকসহ যাবতীয় বিষয়ের মূল উৎস কুরআন হলেও তার বিশ্লেষণ নবীজি (সা.)-এর বাধী ইলমে হাদীসের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, ঈমান-আকায়েদ থেকে শুরু করে সকল ইবাদাত, মু’আমালাত, থেকেই সংগ্রহ করতে হয়। শরিয়ত, মারেফত, তরিকত হাকিকত যাই বলুন না কেন, কোনো কিছুই কুরআন ছাড়া যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনিভাবে হাদীস ছাড়াও গ্রহণযোগ্য নয়। ইলমে হাদীস বাতিত কেউ ইসলামের কোনো আংশের পণ্ডিত বলে দাবি করতে পারবে না। ইসলামের যে কোনো বিষয়ের আলেম হতে হলে তাকে দরসে হাদীসের ছাত্র হতেই হবে। এর বিকল্প কোনো পথ নেই। এ গুরুত্ব অনুধাবন করেই আমাদের আকাবির ও আসলাফণাণ কওমি মাদরাসার নেসাবে বিভিন্ন বর্ষে ছোট ছোট হাদীস মুখস্থের ব্যবস্থা রেখেছেন। অতঃপর এ শিক্ষা সিলেবাসের নবম বর্ষে হাদীসের গ্রহণযোগ্য কিতাব যা সিহাহ সিত্তা থেকে সংকলিত মেশকাতুল মাসাবিহকে দরসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। উক্ত কিতাবের প্রতিটি হাদীসের তরজমা, ব্যাখ্যা, ফিকহি আলোচনা, ইলমে হাদীসের মানদণ্ডে বর্ণিত হাদীসের অবস্থান, সাধারণ দৃষ্টিতে হাদীসে বিদ্যমান বৈপরিত্যের অবসানসহ ইমামগণ মাসায়েলের ক্ষেত্রে হাদীসটিকে কীভাবে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন- এ সকল বিষয় সামনে রেখে কিতাবটি পড়ানো হয়। অতঃপর শেষ বর্ষে নবীজি-এর হাদীস ভান্ডার থেকে সংকলিত সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য কিতাবগুলো পরিমিত বিশ্লেষণসহ পড়ানো হয়। প্রতিটি কিতাবেই ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলির অধ্যায় রয়েছে প্রত্যেক শিক্ষক যদি প্রতিটি অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন তাহলে এক বছরে এ বিশাল নেসাব শেষ করা সম্ভব নয় এজন্যে আমাদের জামিয়ায় বছরের শুরু থেকেই বিশ্লেষণের জন্য অধ্যায় বণ্টন করে দেওয়া হয় কেউ ঈমান ও সালাতের অধ্যায়ের বিস্তারিত বিশ্লেষণ করবেন আর বাকি হাদীসগুলোতে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করবেন। আবার কেউ হয়তো সওম ও যাকাতের বিশ্লেষণ করবেন এভাবে প্রত্যেকটি অধ্যায়কে বিশ্লেষণের অধীনে আনা হয় যাতে করে শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকটি বিষয়ের বিস্তারিত জ্ঞান লাভ করে পারদর্শী হতে পারে।
এক নজরে কিতাব বিভাগে দশ বর্ষে পঠিত বিষয়াবলি :
১. কুরআনুল কারিমের নির্বাচিত সূরাসমূহ মুখস্থ করা।
২. হাফেজ ছাত্রদের হিফজ ইয়াদ রাখার উদ্দেশ্যে হিফজের দাওর।
৩. বাংলা, অংক, ইংরেজি, সমাজ, ভূগোল ও ইতিহাস (অষ্টম শ্রেণি সমমানের)।
৪. উর্দু ভাষা ও সাহিত্য।
৫. ফার্সি ভাষা-সাহিত্য ও ব্যাকরণ।
৬. আরবি ব্যাকরণ।
৭. আরবি সাহিত্য।
৮. হাতের লেখা- বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, আরবি।
১. ফিকহ (ইসলামি আইন)।
১০. উসূলে ফিকহ (ইসলামি আইনের মূলনীতি)।
১১. ইলমে বালাগাহ (অরবি অলঙ্কার বিদ্যা)।
১২. ইলমে মানতিক (যুক্তি বিদ্যা)
১৩. সীরাতুন্নবী সা.
১5. আখলাক ও শিষ্টাচার
১6. কুরআনুল কারিমের অনুবাদ
১7. আকায়েদ ও ইসলামি দর্শন
১8. ইসলামি অর্থনীতি
১9. হাদীস শরীফ
পাঠদান পদ্ধতি
শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই সকল বিভাগের আসাতিযাদের নিয়ে পর্যালোচনা মজলিস অনুষ্ঠিত হয়। কোন কিতাব কীভাবে পড়াতে হবে কোন পদ্ধতিতে কঠিন বিষয়গুলো ছাত্রদেরকে সহজভাবে বোধগম্য করা যায়; অমনোযোগী, উদাস ছাত্রদেরকে কীভাবে পড়াশোনামুখী করা যায়; কীভাবে ছাত্রদের থেকে সবক উসূল করা উচিত; ছাত্রদের প্রয়োজনীয় শাস্তি প্রদানসহ একজন শিক্ষকের করণীয়-বর্জনীয় বিষয়াবলির মৌলিক আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে করা হয়। যাতে প্রত্যেক শিক্ষক তার যোগ্যতানুসারে সফল ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিটি বিষয়ে পারদর্শী শিক্ষকদেরকে উক্ত বিষয়ের দরস প্রদানে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। নাহ, সরফ, আদব, বালাগাতসহ (ফন্নে মাওকুফ আলাইহি) ভিত্তিমূলক বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা হয়। বছরের শুরুতেই শিক্ষাবর্ষের কার্যদিবস অনুযায়ী কিতাবের নেসাব বণ্টন করে দেওয়া হয়। যাতে বর্ষশেষে একই গতিতে প্রত্যেকটি কিতাব শেষ হয়। কোনো কিতাব আধাআধি বা অংশবিশেষ পড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। প্রতি পরীক্ষার পূর্বে রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়। কারো নির্ধারিত পাঠ শেষ না হলে কৈফিয়ত পেশ করতে হয়। এ বিষয়ে মরহুম শাইখুল হাদীস (রহ.) ছিলেন অনেক বেশি সতর্ক। নিজে এ বিষয়ে এতো পাবন্দ ছিলেন, যা অকল্পনীয়। নানামুখী ব্যস্ততার মধ্যেও সবকের ইহতেমাম কেমনা করতেন তা বলতে পারবেন একমাত্র তার সরাসরি ছাত্রবৃন্দ
যে কোনো ক্লাসে যাওয়ার আগে মুতালাআ করে যাওয়া, যথাসময়ে সবকে উপস্থিত হওয়া, হওয়া, পূর্ণ সময় সবক পড়ানো, ছাত্রদের সময়কে আমানত মনে করে অত্যন্ত আবেগ-আগ্রহ নিয়ে সবক পড়ানো, কঠিন ও দুর্বোধ্য বিষয়গুে সহজভাবে পেশ করার ফিকির করা, কোনো ক্রমেই সবক নাগাহ না দেওয়া- এসব বিষয় হযরত শাইখ (রহ.) নিজে আমল করে দেখিয়েছেন এবং তাঁর সহকর্মীদের অভান্ত করে রেখে গেছেন। বিধায় ব্যতিক্রম কোনো পরিবেশই আলহামদুলিল্লাহ আমাদের জামিয়ায় বিদ্যমান নেই প্রাথমিক ক্লাসগুলোতে আগামী দিনের সবক ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ইয়াদ করিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা আমরা করে থাকি। মৌখিক বলার সাথে সাথে লিখে উত্তর প্রদানের অভ্যাস ক্লাসেই করিয়ে দেওয়া হয়। সাপ্তাহিক সবক ইয়াদ রাখার জন্য সাপ্তাহিক পরীক্ষার আয়োজন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষক মৌখিক বা লিখিতভাবে এ পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। উচ্চতর শিক্ষার্থীদের মূল কিতাবের ইবারত আয়ত্ব করা, সরল অনুবাদ ও মর্মার্থ উপলব্ধির উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। মূল কিতাবের হাশিয়া, টিকা (বাইনাস সতর) পড়া ও বুঝার প্রতি উৎসাহিত করা হয়। বিশ্লেষণধর্মী কোনো বিষয় থাকলে তাকরির লিখিয়ে দেওয়া বা সহায়ক কিতাবের সন্ধান দেওয়া ২হয়। গাইড বা অনির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে বিরত থাকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
পরীক্ষা পদ্ধতি
সকল বিভাগের ছাত্রদের বছরে তিনটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ১ম সাময়িক পরীক্ষা: সফর মাসের প্রথম সপ্তাহে ৯ দিনব্যাপী, ২য় সামায়িক পরীক্ষা জুমাদাল উলা মাসের প্রথম সপ্তাহে ১০ দিন ব্যাপী আর বার্ষিক পরীক্ষা শাবান মাসের শুরুতে দশ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। তবে বার্ষিক পরীক্ষায় তাকমীল, ফযিলত সানি, সানবি সানী, উস্তানি সানী, ইবতিদায়ি সানী ও হিফজ বিভাগের খতমি ছাত্রদের পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে বেফাকের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। আর উস্তানি আউয়ালের পরীক্ষা মোহাম্মাদপুরস্থ আঞ্চলিক বোর্ড ‘ইত্তিফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া’-এর অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষার আয়োজন অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও সুষ্ঠু হওয়ার কারণে পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে গোটা মাদরাসায় পড়ালেখার এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয় যে, অমনোযোগী ছাত্র পর্যন্ত পড়াশোনার তালে পড়ে যায়। সাময়িক পরীক্ষা উপলক্ষে এক সপ্তাহ এবং বার্ষিক পরীক্ষায় আরও বেশি সময় সবক বন্ধ থাকে। সবক বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে সকল ছাত্রদেরকে জমায়েত করে পরীক্ষার প্রস্তুতি, কৌশল, নিয়ম-কানুন বাতলানোসহ যাবতীয় দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়। পড়ালেখার জন্য তারগিব-তারহিব প্রদান করা হয়। এতে প্রতিটা ছাত্রই সাহস ও উদ্যমের সাথে পড়ালেখা করার হিম্মত পায় ও সময়কে কাজে লাগিয়ে নিজ নিজ অবস্থান অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আমাদের সাময়িক পরীক্ষাগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, কোনো শিক্ষক নিজে পড়ানো কিতাবের পরীক্ষা নিতে পারেন না; বরং অন্য শিক্ষক পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। ছাত্রদের পরীক্ষার সাথে সাথে শিক্ষকের পড়ানোর মানও যাচাই হয়ে যায়। এতে পরীক্ষার উসিলায় শিক্ষকবৃন্দও সতর্ক থাকেন এবং ছাত্ররাও ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ অনুভব করে। সব মিলে প্রতিটি পরীক্ষা ছাত্রের ইলমী তারাক্তির জন্য বিশাল সহায়ক হয়ে থাকে। কোনো ছাত্র যে কোনো যৌক্তিক কারণেও পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ না করলে পরবর্তীতে তার পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এতে পরীক্ষা এড়ানোর কোনো সুযোগ থাকে না। পরীক্ষার ফলাফলের সাথে ফ্রি খানা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সংশ্লিষ্ট। প্রতি পরীক্ষার পর নির্ধারিত গড় নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হলে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল ছাত্ররা ফ্রি খানার সুযোগ পেয়ে থাকে। এমনিভাবে পরবর্তী মাসে হাজিরা খাতায় মেধা তালিকা অনুযায়ী নাম উঠানো হয়। এতে প্রতিযোগিতার মনোভাব শাণিত হয়।
দরসে উপস্থিতি
শিক্ষায় উন্নতির জন্য নিয়মিত ক্লাস অতীব জরুরী বিষয়। শিক্ষক ও ছাত্রের নিয়মিত উপস্থিতি ছাড়া কোনোভাবেই উন্নতি সম্ভব নয় (আমাদের কওমি মাদরাসার মধ্যে যারা তুলনামূলক পিছিয়ে আছে, তাদের এ দুর্বলতাটা সবচেয়ে বেশি)। শিক্ষক ও ছাত্রদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য জামিয়ার রয়েছে পরিকল্পিত আয়োজন। শিক্ষক বা ছাত্র কেউ অনুপস্থিত থাকলে যেমনিভাবে কানুনের জালে আটকা পড়তে হয়। তেমনিভাবে গোটা বছর উপস্থিত থাকলে পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করা হয়।
বাৎসরিক ছুটিসমূহ
কুরবানি উপলক্ষে ১দিন। প্রথম সাময়িক পরীক্ষা উপলক্ষে ৭দিন। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা উপলক্ষ্যে ৭দিন। বার্ষিক পরীক্ষার পর পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে ১৫ শাবান থেকে ৮ শাওয়াল পর্যন্ত। তবে হিফজ ও মক্তব বিভাগের জন্য ২৩ রমজান থেকে ৮ শাওয়াল পর্যন্ত বিভাগীয় শিক্ষকবৃন্দ উক্ত ছুটি পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া সরকারি ছুটিসমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছুটিগুলোর বিষয়ে শিক্ষকবৃন্দের সাপ্তাহিক পরামর্শ সভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।