শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক
জাগতিক কার্যক্রম ও ঘটনা-প্রবাহ সাধারণত : দুই প্রকার।
১। যা মানুষের কোনো হস্তক্ষেপ বা ইচ্ছা-অনিচ্ছা ব্যতিরেকে স্বভাবতই অনিুষ্ঠিত হয়ে থাকে যাকে প্রাকৃতিক ঘটনা বলা হয়। ২। যা মানুষের দ্বারা এবং তারই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে যাকে মানবিক কার্য্যক্রম বা মানুষের দ্বারা সম্পাদিত কাজ বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে উক্ত উভয় প্রকারের সমস্ত বিষয় ও ঘটনাসমূহ যতো বড়, যতো ছোটই হোক না কেন, প্রতিটি কাজ ও ঘটনার মধ্যেই সর্বশক্তিমান আল্লাহর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব রয়েছে। তদুপরি আল্লাহ যেহেতু সর্বজ্ঞ, আলেমুল গায়েব; তাই অনন্তকালব্যাপি যে কোনো প্রকার যা কিছু ঘটবে বা যা দ্বারা যা কিছু অনুষ্ঠিত হবে, অনাদিকাল থেকেই আল্লাহ তা’য়ালা সেসব জানেন। এমনকি আল্লাহর সেই অভ্রান্তজ্ঞান অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট টাইম-টেবিলের পূর্ণ তালিকা তিনি প্রস্তুত রেখেছেন।
যেহেতু আল্লাহর ইলম বা জ্ঞান কখনও ভ্রমাত্মক বা অপ্রকৃত, অবাস্তব হতে পারে না, সুতরাং সে তালিকার বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম হওয়া সম্ভব নয়। উপরোল্লিখিত বিষয়ের সমষ্টির নামই হলো ‘তাকদীর’ বা অদৃষ্ট-নিয়তি।
এ বর্ণনায় স্পষ্টত দেখা যায় যে তাকদীর বলতে যা কিছু বুঝায় তা বস্তুত আল্লাহ তা’য়ালার দুইটি সিফাত বা গুণেরই বিশেষ অনুচ্ছেদ মাত্র। এর একটি হলো কুদরত অর্থাৎ আল্লাহ তা’য়ালার সর্বশক্তিমান হওয়া। আর দ্বিতীয়টি হলো ইলম অর্থাৎ আল্লাহর অনাদিকাল থেকেই সর্বজ্ঞ ও সর্বজ্ঞানী হওয়া।
জাগতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রথম প্রকারের ঘটনাসমূহ সম্বন্ধে তাকদীরের বিষয়ে বিশেষ কোন দ্বিধা বা সংশয়ের উদয় ছিলো না। এমনকি এ প্রকারের কোনো ঘটনা কোনোভাবে বাহ্যিক কারণ ও হেতুর আবরণে পরিবেষ্টিত থাকলেও, যেহেতু কার্য কারণ পরম্পরায় শেষ পর্যন্ত ঐ কারণের কারণ তথা মূল কারণ হাতড়িয়ে পাওয়া যায় না কিংবা নিজেদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের দ্বারা তার রহস্যজাল ভেদ করতে অসমর্থ হয়। তাই বাধ্য হয়ে সেখানে তাকদীরকে স্বীকার করে নেয়া হয় এবং নিজেদের পরিভাষায় তাকে প্রাকৃতিক বলে অভিহিত করা হয়।
আর দ্বিতীয় প্রকার অর্থাৎ মানুষের দ্বারা অনুষ্ঠিত কার্যক্রম সম্বন্ধে তাকদীরের বিষয়ে নানা প্রকার সংশয়ের উদয় হয়ে থাকে। তাই এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে সম্পূর্ণ অক্ষম নির্জিব জড় পদার্থরূপে সৃষ্টি করেন নি। কিংবা স্বয়ং সম্পূর্ণ, সক্ষম, সর্বশক্তিমান করেও সৃষ্টি করেন নি। বরং আল্লাহ মানুষকে নেহায়াত স্বাভাবিক, সীমাবদ্ধ ও পরিমিত জ্ঞান ও বিভিন্ন শক্তি দান করে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তা হলেও ঐ সব প্রদত্ত শক্তিসমূহকে আল্লাহ তা’য়ালা একান্তই স্বীয় কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রাণাধীনে রেখেছেন। অবশ্য তার কর্তৃত্বের বিধানে এটাও বিধিবদ্ধ করে রেখেছেন যে, মানুষ তার শক্তিসমূহ কোনো ভালো বা মন্দ পথে পরিচালিত করলে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনোরূপ প্রত্যক্ষ বাধা সৃষ্টি করার কোনো বাধ্যবাধকতা মোটেই থাকবে না; অন্যথায় কর্ম জগতের মূল রহস্য ‘পরীক্ষা’ অনুষ্ঠিত হতে পারে না।
মানবকে উল্লেখিত শ্রেণীর শক্তিতে শক্তিমান করে, ভালোমন্দ চেনার জন্য শরীয়তকে মাপকাঠি হিসেবে প্রদান করে আল্লাহ তা’য়ালা মানবকে কর্মক্ষেত্রে পাঠিয়েছেন পরীক্ষার দ্বারা প্রকাশ করে দেয়ার জন্য যে সে কোন পথ অবলম্বন করে।’ চিন্তা করে দেখুন মানুষ নিশ্চিতরূপে স্বীয় কর্মফল ভোগ করবে না কেন? নিশ্চয় ভোগ করবে। কারণ, আল্লাহ তা’য়ালা মানবকে যে ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতাটুকু দান করেছেন যদ্বারা মানব জাতি অপরাপর অক্ষম নির্জীব জড়পদার্থ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ও ভিন্ন পরিগণিত হয়; সে শক্তি ও ক্ষমতাকে সৎ বা অসৎ বা ভালোমন্দ উভয় পথে পরিচালিত করার স্বায়ত্বশাসিত ক্ষমতা আল্লাহ তা’য়ালা মানবকে দিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য সেই ক্ষমতা আল্লাহর মহাক্ষমতার অধীনেই বটে। কিন্তু এই বিধানও জানিয়ে দিয়েছেন যে, মানবকে তার ক্ষমতা চালনায় বাধা দেয়ার ধরা বাধা নিয়ম রাখা হয়নি। যেমন পরীক্ষার্থী ভুল অঙ্ক লিখতে থাকে, পরীক্ষক মাস্টার ভুল লেখতে দেখে এবং বাধা দেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বাধা দেন না। এতদসত্ত্বেও ভুলের জন্য ছাত্র অবশ্যই দায়ী হয়; তার নম্বর কাটা যায়, সে ফেল করে। তদ্রুপ আমাদের এ আলোচনার ক্ষেত্রেও নিজ ক্ষমতায় মন্দ পথে পরিচালনার জন্য মানবই দায়ী। এমতবস্থায় তকদীরের ওপর বিশ্বাস স্থাপনে কর্মক্ষেত্রে কোনো বাধার সৃষ্টি হতে পারে কি?
তাকদীর বলতে আল্লাহর যে অসীম কর্তৃত্ব, প্রাধান্য ও শক্তিমত্তা বুঝায়, তার ওপর বিশ্বাস স্থাপনের দ্বারা বহু সুফল প্রতিফলিত হতে পারে।
এক. কর্মক্ষেত্রে মানুষ নিজকে বাহ্যত যৎকিঞ্চিত ক্ষমতাবান দেখতে পেলেও সে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ তথা অবিমিশ্র শক্তির অধিকারী বলে ধারণা করবে না। যেমনভাবে ফেরাউনপ্রকৃতির ব্যক্তিগণ নিজেদের সম্পর্কে সে প্রকার ধারণা পোষণ করতো, যা বাস্তবায়িত করতে গিয়ে বহু অশান্তির সৃষ্টি করে থাকে।
দুই. আল্লাহ তা’য়ালা যে মহান ও সর্বশক্তিমান তা সর্বদা মনে জাগ্রত থাকবে এবং নিজকে সর্বদাই তার মুখাপেক্ষী, সাহায্যপ্রার্থী ও দয়ার ভিখারী হিসেবে গণ্য করে জীবনের সকল কার্য পরিচালিত করবে।
তিন. কোনো কাজে শত চেষ্টার পরও অকৃতকার্য বা বিফল হলে তাতে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে একেবারে মন ভেঙ্গে ধৈর্যহারা হয়ে পড়বে না, বরং স্বীয় মনকে এ বলে প্রবোধ দান করবে যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা’য়ালার তরফ থেকে এমনটি হয়েছে এবং নিশ্চিত এর অন্তরালে হয়তো আল্লাহ তা’য়ালার এমন কোনো সুফলপ্রসূ ইঙ্গিত অথবা মঙ্গলসূচক ইচ্ছা নিহিত রয়েছে যার দ্বারা এটা আমার জন্য তার অভিপ্রেত ছিলো তাই এতে আমাদের কিছুই করার নেই; আমরা তো তার গোলাম মাত্র। অতএব মনিবের যা ইচ্ছা গোলামের প্রতি করতে পারেন। মনের মধ্যে এই প্রকার ভাবজাগ্রত করার ধৈর্য ধারণপূর্বক উৎসাহ ও উদ্দীপনাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
চার. কোনো বিষয়ে বাহ্যত স্বীয় চেষ্টা ও শক্তির দ্বারা কর্তৃকার্য ও সফলকাম হলেও তজ্জন্য সে ব্যক্তি ফেরাউন প্রকৃতির হবে না, বরং মনে মনে আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞ ও শোকরগোজার হবে এই ভেবে যে, আল্লাহ তা’য়ালা তার অপার করুণাবলে আমাকে এ সাফল্য লাভের তৌফিক ও সুযোগ দান করেছেন; ফলে তার স্বভাবে নম্রতা আসবে; উগ্রতা ও ঔদ্ধত্য সৃষ্টি হবে না, আল্লাহর বান্দাদের প্রতি সে বিনয়ী ও সদয় হবে।
এ সবই হচ্ছে তাকদীরের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের অনিবার্য ও বাস্তব প্রতিক্রিয়ার সুফল। এর পরিবর্তে কেউ যদি তাকদীরের নামে স্বীয় কর্মজীবনে দুর্বলতা টেনে আনে, অর্থাৎ অকর্মণ্য, নিরুৎসাহ ও উদ্যমহীন হয়ে পড়ে তবে তা ঐ ব্যক্তির নিজের ত্র“টি ও শয়তানের ধোকা ব্যতীত আর কি হতে পারে?
তাকদীরের যে সংজ্ঞা ও তাৎপর্য বর্ণিত এবং তাকদীরের ওপর ঈমান স্থাপনের যে ফলাফল ব্যক্ত হলোএ সব তথ্যের প্রতি পবিত্র কুরআনেই ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহ বলেন ভূপৃষ্ঠে যে কোনো বিপদ-আপদ, দুর্যোগ-দুর্ভোগের আগমন হয় এবং তার যে কোনটা কারো ওপর আসে তার প্রতিটিই কিতাবে তথা লৌহে মাহফুজে লিখিত আছে উক্ত বিপদ ও দুর্যোগকে আমি সৃষ্টি করার পূর্বেই ( বরং ঐ মানুষটিকে সৃষ্টি করার পূর্বেই। তদ্রুপই জগতে যখন যখন যে সুযোগ-সুদিন, সুখ-সমৃদ্ধির সঞ্চার হয় এবং তা যে কারো জীবনে সমাগত হয় তাও কিতাবে লিখিত আছে তাকে সৃষ্টি করার পূর্বে। এমনিভাবে লিখে রাখা (আমি) আল্লাহর পক্ষে নিতান্তই সহজ ব্যাপার। এই তথ্যটা তোমাদেরকে অবগত করা হলো শুধু এ উদ্দেশ্যে যে, তোমরা কেউ কোনো মনোবাঞ্ছনা থেকে বঞ্চিত বা তা লাভে ব্যর্থ হলে কিংবা কোনো ধন-জনহারা হলে সে যেনো ক্ষোভ-বিহ্বল বা শোকাহত হয়ে না পড়ে। ধৈর্যধারণ করে মনোবল অক্ষুন্ন রাখে) এবং কেউ আল্লাহর তরফ থেকে ভালো অবস্থা প্রাপ্ত হলে সে যেনো ঔদ্ধত্যে, দম্ভে ও খুশিতে উন্মাদ না হয়; (শুকরগোজার-আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞ ও বান্দাদের প্রতি বিনয়ী হয়। কোনো অহঙ্কারী দাম্ভিককে আল্লাহ মোটেই পছন্দ করেন না। সূরা-
তাকদীরের ওপর ঈমান ও দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা যে অপরিহার্য তা মুসলিম শরীফের একটি হাদিস দ্বারা বিশেষভাবে প্রমাণিত। হাদিসটি হচ্ছে
এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. কে বললেন, আমাদের দেশে নতুন মতবাদের একদল লোক আবির্ভূত হয়েছে। তারা একদিকে বেশ কুরআন শরীফ পাঠ করে থাকে এবং জ্ঞান-চর্চা তথা ধর্মীয় গবেষণাদিও করে থাকে, কিন্তু অন্যদিকে তারা তাকদীরের প্রতি বিশ্বাসী নয়; বরং তারা তাকদীরকে অস্বীকার করে থাকে। এতদশ্রবণে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বললেন, তাদেরকে বলে দাও যে, আমাদের তথা খাঁটি মুসলিমগণের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্রব নেই; তারা মুসলিম জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন। আমি মহান আল্লাহর শপথ করে বলছি, তারা যতো প্রকার ও যতো বড় নেক আমলই করুক না কেন, এমনকি পাহাড় সমতুল্য স্বর্ণও যদি তারা আল্লাহর রাস্তায় দান-খয়রাত করে, তথাপি তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না; তারা তার কোনো সওয়াবও পাবে না। যতোক্ষণ না তারা উক্ত ইসলামবিরোধী ধারণা ও মতবাদ পরিত্যাগ করে তাকদীরের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও ঈমান স্থাপন না করে।
সুপ্রিয় পাঠক! এখানে তাকদীরের যে ব্যাখ্যা ও তত্ত্ব প্রকাশ করা হয়েছে সে অনুযায়ী সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরের এই উক্তি অত্যন্ত সঙ্গত। তাকদীরকে অস্বীকার করা প্রকারান্তরে আল্লাহ তা’য়ালার দুটি বিশেষ সিফাত ও গুণকে অস্বীকার করা। কারণ, পূর্বেই বলা হয়েছে, তাকদীর বলতে যা কিছু বুঝায় বস্তুত তা আল্লাহ তা’য়ালার দুটি সিফাত বা গুণেরই অনুচ্ছেদ মাত্র। বলাবাহুল্য যে কোনো ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার কোনও একটি সিফাত বা গুণকে অস্বীকার করলে ঈমান ও ইসলাম বহাল থাকতে পারে না।