নারী নীতিতে ইসলাম বিরোধী ভাবধারা : বিরোধ নিরসনে সততা ও সচ্ছতার বিকল্প নেই

ওবায়দুর রহমান খান নদভী

বিষয়টি অনেক পুরনো এবং বিতর্কটি যথেষ্ট জটিল হলেও জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১-এর উত্তরাধিকার সম্পদে নারী-পুরুষ সমান অধিকার প্রসঙ্গ নিয়েই প্রধাণত বর্তমান বিতর্ক। সরকার পক্ষ বলছে, নারী উন্নয়ন নীতিতে উত্তরাধিকার সম্পদে নারী-পুরুষ সমান অধিকারের কথা বলা হয়নি। ইসলামি আইনবিদ, ওলামা-মাশায়েখ তথা মুসলিম নাগরিকদের ধর্মীয় অভিভাবকগণ বলেছেন, নারী উন্নয়ন নীতির ১৬.১, ১৬.৮, ১৬.১১, ১৬.১২, ১৭.১ ধারাসমূহে সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান অধিকার বৈষম্য দূরিকরণ, বিশেষ করে অর্থ সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রে সমঅধিকার প্রদানের যে বক্তব্য রয়েছে, উত্তরাধিকার সক্রান্ত বিধান যে এর বাইরে থাকবে এর নিশ্চয়তা কোথায়? সুতরাং প্রচ্ছন্নভাবে এ কথা অবশ্যই বলা হয়েছে যে, আইন তৈরির সময় সব ধরনের বৈষম্যই দূর করা হবে এবং সকল ক্ষেত্রে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ সম্ভাবনা আরো প্রকট ও সুস্পষ্ট হয়ে গেছে ১৭.৩, ১৭.৪, ১৭.৫, ধারাসমূহ থেকে। পাশাপাশি দেশের আলেম সমাজ, মুফতি ইসলামি আইনবিদদের বক্তৃতা ও বিবৃতিতে দেখা যাচ্ছে যে, তারা বলছেনÑ নারী উন্নয়ন নীতি ২৩.৫ ধারা সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায়িক নারীকে সমান সুযোগ ও অংশিদারিত্ব দেয়া। অংশে সম্পদ বলতে নারীর উত্তরাধিকার সম্পদও অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ থেকে যায় এবং এ ক্ষেত্রেও ২৫.২ ধারায় বর্ণিত উপার্জন উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি, এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা প্রযোজ্য হতে পারে। সুতরাং এ দুটি ধারা মিলিত অর্থ ও ফলাফল ভবিষ্যতে কোন দিকে গড়াবে এ নিয়েও তারা উদ্বিগ্ন। তা ছাড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত মূল নীতিমালায় তো উত্তরাধিকার সম্পদও অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে আলেমদের প্রতিবাদে তা মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা বদলে ফেলে নারী নীতির বর্তমান রূপ দেন। এতে জনগণ বিভ্রান্তির শিকার হন এবং প্রতিবাদকারীগণ বেকায়দায় পড়ে যান। মন্ত্রিদের কেউ কেউ বলেনÑ কই, নারী নীতি তো ইসলাম বিরোধী কিছুই নেই। এ ধরনের বাল্যসূলভ আচরণে জনমনে অবিশ্বাস ও সন্দেহ আরো দানা বাঁধে। প্রতিবাদ ও আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রি, আইন প্রতিমন্ত্রি ও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রির বক্তব্যের জবাবে বলা হয়েছে ২৩.৫ এবং ২৫.২ ধারা দু’টির মিলিত ব্যাখ্যা এক সময় উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমান অধিকার দাবীর প্রেক্ষাপট তৈরি করবে এবং এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের দাবী জোড়দার হবে। সুতরাং স্পষ্ট সিদ্ধান্ত ও সরকারের অবস্থান পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত নারী নীতি গ্রহণযোগ্য নয়। সবচেয়ে মারাত্বক যে বিষয়টি আলেম সমাজ ও মুসলিম জনগণকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে, সেটি হচ্ছে, নতুন নারী নীতির ১৭.২ ধারা। এতে বলা হয়েছে, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলুপ সনদ (সিডো)-এর প্রচার ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা। এখানো সিডো বাস্তবায়নের যে নীতি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, এটাকে আলেম সমাজ কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক তথা ইসলাম বিরোধী রীতি-নীতির বাস্তবায়নের চাবিকাঠী বলে আখ্যায়িত করেছেন । কেননা ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংঘে গৃহিত এই সনদটির লক্ষ ছিল রাষ্ট্র, অর্থনীতি, পরিবার সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরিকরণ। নারীর জন্য আন্তর্জাতিক বিল অব রাইট্স বলে চিহ্নিত এ দলিল নারী অধিকার সংরক্ষণের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মানদন্ড বলে বিবেচিত। সিডো বাস্তবায়নের জন্য দেশে সংবিধান আইন ও রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যন্ত বদল হতে পারে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার, জোট সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নারী নীতি বিষয়ে যে বিতর্ক-এর মূল কেন্দ্রই ছিল এই সিডো সনদ। আলেম সমাজ এটাই বলে এসেছেন যে, ধর্মীয় ক্ষেত্রে অবধারিত যে সুষম ব্যবস্থা এর তাৎপর্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বিবেচনা না করে সব ক্ষেত্রে সমঅধিকারের নামে যেনো ইসলাম বিরোধী আইন তৈরি না হয়। বিগত সময়ের প্রতিবাদ ও বিতর্ক নারী নীতির ভাষাগত বিবর্তন, কৌশলী শব্দ প্রয়োগ বা বাক্য বিন্যাসের চেয়ে সিডো সনদ নিয়েই ছিল বেশি। কোনোরূপ পরিমার্জন বা শর্ত ছাড়া হুবহু সিডো সনদের আগে কোনো প্রস্তাবিত নারী নীতিতেও গৃহিত হয়নি। বর্তমান নারী নীতিতে সেই সিডো সনদ হুবহু গৃহিত হওয়ায় আলেম সমাজ, মুফতি, ইসলামি আইনবিদ ও সাধারণ মুসলিম জনতা চরম বিস্মত। পাশাপাশি তারা আরো হতাশ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে কারচুপিমূলক ঘষামাজা ও সরকারের দায়িত্বশীলদের বক্তব্য ও বিবৃতি দেখে। যেখানে তারা বলতে চাচ্ছেন যে, নারী নীতিতে ইসলামের সাথে সংঘর্ষিক কিছু নেই। সিডো সনদের বাস্তবায়নে যে নীতি অঙ্গীকারাবদ্ধ, সেটাকে যদি আলেম সমাজ কুরআন ও ইসলামি বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক একটি নিরব টাইম বোমা বলে আখ্যায়িত করে থাকেন, তাহলে কি এটা তাদের অত্যুক্তি হবে? সিডো সনদে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী ধারাগুলো অতীতের বিভিন্ন বিতর্ককালে বিজ্ঞ আলেম ও মুফতিগণ চিহ্নিত করেছেন। সরকারের রেকর্ডপত্রে সেগুলো রক্ষিত আছে। সিডোর যেসব ধারা উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষ সমবণ্টন নীতি সাব্যস্ত করে, সেগুলো বাদ দিয়ে সিডো বাস্তবায়নের প্রস্তাব নতুন কিছু নয়। তাহলে হুবহু সিডো বাস্তবায়নের এ সিদ্ধান্ত নতুন নারী নীতিতে গ্রহণ করে সরকার কীভাবে বিতর্ক এড়াতে চান, সেটাই আজকের জিজ্ঞাসা।

এক পর্যায়ে মুসলিম জনগণ ও আলেম সমাজকে নির্বোধ না ভেবে সরকারকে সততা ও সচ্ছতার সাথে বিতর্ক অবসানের পথে এগুতে হবে। নারী উন্নয়ন নীতি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর যখন মহিলা ও শিশু প্রতি মন্ত্রি ড.শিরীন শারমিন চৌধুরী বললেন, ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। এটি কার্যকর করার জন্য কোনো আইন করা হবে না। নতুন নীতিতে উত্তরাধিকারসহ উপার্জন ও বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদে নারীকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অধিকার দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে উত্তরাধিকার সম্পদে নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। (কালের কণ্ঠ ঢাকা মঙ্গলবার ৮ই মার্চ ২০১১)। তখন পর্যন্ত নারী নীতির খসরার কপি মন্ত্রিসভার বাইরের কেউ পায়নি। ওয়েব সাইটেও ছাড়া হয়নি। মূলকপির আলোকেই সম্ভবত কালের কণ্ঠকে মাননীয় প্রতিমন্ত্রি নারী নীতি সম্পর্কে এসব কথা বলেন। ধরা যায়, মূলত এ নিউজটি থেকেই ধর্মপ্রাণ মুসলিম নাগরিক এবং তাদের ধর্মীয় অভিভাবক শ্রেণী নারী নীতিতে নারী-পুরুষ সমঅধিকারের ধরনটি জানতে পারেন। প্রতিবাদ, নিন্দা, বিক্ষোভ বা আন্দোলন যাই বলি, সব শুরু হয় ড.শিরীন শারমিনের এই বক্তব্যের ফলেই। প্রতিমন্ত্রির বরাত দিয়ে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষা ও ভাষ্যে যে কথাটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তিনি এর কোন প্রতিবাদ করেছেন বলেও শোনা যায়নি। জন সাধারণের জানাটা শুদ্ধ ও প্রামাণ্য হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে প্রতিমন্ত্রির এ বক্তব্য কি যথেষ্ট ছিল না? পরিবার সমাজ ও সভ্যতার স্বাভাবিক কাঠামোর সুরক্ষায় সচেষ্ট ও ধর্মীয় বিধান প্রতিপালনে আগ্রহী মানুষ আরো উদ্বিগ্ন হন মিডিয়ায় প্রচারিত এতো সংশ্লিষ্ট আরো কিছু লেখা ও উক্তি লক্ষ করে। যেখানো দায়িত্বশীল অনেকের মুখ থেকেই ধর্মবিরোধী কিছু মন্তব্য ও উক্তি প্রকাশিত হয়। যা নির্মমভাবে বাংলাদেশের ধর্মবিশ্বাসী মানুষের অনুভূতিকে আহত করে। নারী নীতির খসরাকে ভর করে একটি মহল যে আরো অনেক দূর এগুবার স্বপ্ন দেখেন, তারা যে সীমালঙ্ঘনের পাঁয়তারা করেছেন, তা আন্দাজ করতে পেরেই মানুষ ক্ষুব্ধ ও চিন্তিত হয়ে পড়ে। দেশে নারী সংক্রান্ত যেসব আইন ও নীতি আছে, তা অপ্রতুল ছিল বলেই সরকার নতুন নীতি প্রণয়ন করেছে, এখন সেই নীতির আলোকে সংশ্লিষ্ট আইনেও পরিবর্তন আনতে হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কারিগরী শিক্ষা, উপার্জনের সুযোগ, উত্তরাধিকার সম্পদ, ঋণ প্রযুক্তি ও বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদসহ ভূমির উপর অধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ ও সমান সুযোগ। তবে আমরা মনে করি, নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় ভালো নীতি গ্রহণই যথেষ্ট নয়। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক যতো আইন আছে, সেই নীতির আলোকে তা পরিবর্তন করতে হবে।

(সম্পাদকীয়র অংশ বিশেষ প্রথম আলো। ঢাকা, ৯ই মার্চ ২০১১)।

নারী নীতি থেকে উদ্বৃত, এর নীতিগুলোর মর্মার্থ তুলে ধরা এ নিবন্ধনে প্রণয়নের যে প্রেরণার বিষয়টি উঠে এসেছে, এটি নারী নীতির স্বার্থকতার জন্য খুবই জরুরি। কিন্তু ধর্মপ্রাণ মুসলমান যদি এখানে উত্তরাধিকার সম্পদেও নারী-পুরুষ সমান বণ্টনের যুক্তি বিরোধী এবং পবিত্র কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক আইন জারীর আশঙ্কা করে, তাহলে বিষয়টি কি অমূলক হবে? নারী নেত্রী সালমা খান নারী নীতির প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘নীতিমালাটি আইনে পরিণত করা দরকার। কারণ, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নারী যখন আদালতে যাবে, তখন নীতিমালা গুরুত্ব পাবে না। পরবর্তী আইন কি বলে, তাই গুরুত্ব পাবে’। এখানে স্বাভাবিকভাবেই নীতি বাস্তবায়নের জন্য আইনের পরিবর্তন, নতুন আইন প্রণয়ন বা গোটা নীতিমালাটিকেই আইনে পরিণত করার কথা উঠবে। তাহলে সরকারী তরফ থেকে ‘এটি কোনো আইনই নয়’ মর্মে যা বলা হচ্ছে, তার উপর ধর্মপ্রাণ মানুষ কতটুকু ভরসা রাখতে পারবেন, সেটা সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। ১০ই মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবের এক অনুষ্ঠানে আইন মন্ত্রি ব্যারিষ্টার শফিক আহমাদ বলেছেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাততে আসে এমন কোনো বিষয় নারী উন্নয়ন নীতিতে নেই। সংবিধান অনুসরণ করেই নীতিটি করা হয়েছে। কিন্তু একটি মহল বিনা কারণে রাজনৈতিক ইসু সৃষ্টির জন্য এই নীতির বিরোধীতা করছে। আমাদের সংবিধানে সমান অধিকার সংক্রান্ত যে কটি ধারা রয়েছে, এর মধ্যে ২৮ (২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।’ কথাটিই অধিক স্পষ্ট। এর আলোকে যারা সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকর প্রতিষ্ঠা করতে চান, তারা কি নারী-পুরুষের মধ্যকার জৈবিক পার্থক্যও প্রকৃতিগত ব্যবধানের বিষয়টি বোঝেন না? নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষাও তো সংবিধানে স্বীকৃত। অতএব নির্বিচারে সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার প্রবক্তারা সংবিধানের ধারাসমূহের ওজন আওতা ও ভারসাম্য সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জেনে নিলেই সম্ভবত তারা স্বাভাবিক চিন্তায় ফিরে আসবেন। সংবিধান রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরের নারীকেই সমান অধিকার দিয়েছে, জৈব, প্রাকৃতিক, ধর্মীয় ও ফলিত সামাজিক জীবনে দিতে পারেনি। তা রাষ্ট্র বা সংবিধান পারেও না। এ পথ সকল প্রতিপক্ষের জন্যই অগম্য। সুতরাং সংবিধানের আলোকে নারী নীতি হয়েছে, উত্তরাধিকার সংক্রান্ত কুরআনী আইন লঙ্ঘিত হয়নি। ধর্মীয় অনুভূতি আহত হওয়ার কোনো কারণ কেউ দেখতে পাচ্ছেন না। যারা ক্ষুব্ধ হচ্ছে, নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্যে দায়িত্বশীলরা যাচ্ছে তাই মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি, স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রি, পুলিশের আইজি একই ভাষায় প্রতিবাদকারীদের কর্মসূচী শক্ত হাতে দমনের কথা বলে চলেছেন। ফৌজদারী ভীতিতে তাদের সাথে আচরণ করবেন বলে আগাম জানিয়ে দিচ্ছেন। এ সবই কি সমস্যা নিরসনের পথ? ক্ষোভ ও আঘাতটি কোন জায়গায়, এটি প্রশমনে কি করা উচিত, এ সব নিয়ে ভাবার মত কেউ কি সরকারে নেই? পরিস্থিতি সৃষ্টিতে কি সংশ্লিষ্টদের কোনো ত্র“টি বা দায় নেই। সরকারের কর্মকান্ডে আস্থা বা ভরসা হারানোর মতো কিছুই কি ঘটেনি এখানে? ধর্মপ্রাণ মানুষ যদি সরকারের কোনো কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তির ম্যাকানিজমে বিচলিত বোধ করে থাকে, তাহলে কি তাদের এ বিব্রত ও অস্থিরতাবোধ পূর্ণতই অযৌক্তিক ও অমূলক প্রতীয়মান হবে? মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের ঠিক তিন দিন পরই নারী উন্নয়ন নীতিমালাকে ঘষামাজা করা হলো। উত্তরাধিকার আইনের (মিরাসী আইন) উপর হস্তক্ষেপ করার কারণে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝর উঠায় নীতিমালায় সমঅধিকার শব্দের জায়গায় পূর্ণনিয়ন্ত্রণ শব্দ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রির কক্ষে বসে এই শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে বলে মন্ত্রণালায়ের এক কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রি ড.শিরীন শারমিন চৌধুরী গত বুধবার তাৎক্ষনিক সংবাদ সম্মেলনের দাবী করেন, মুসলিম সম্পত্তি আইনের সাথে বর্তমান নারী নীতির কোন বিরোধ নেই। বর্তমান নারী নীতিতে উত্তরাধিকার সম্পদে সমান অধিকারের কথা উল্লেখ নেই। অথচ গত ৭ই মার্চ এই নীতিমালা অনুমোদনের পর সরকারী সংবাদ সংস্থার (বাসস) খবরে বলা হয়েছে, ভূমিসহ সম্পদ, সম্পত্তি ও উত্তরাধিকারে নারীর সমান অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ এর খসরা অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিসভার নীতিমালা অনুমোদনের পর তিন দিন এটি নিয়ে লুকোচুরী করা হয়েছে। অনুমোদিত নারী উন্নয়ন নীতিমালাকে গত তিন দিন আলোর মুখ দেখতে দেয়া হয়নি। মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার সাথে গতকাল বিকালে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, শব্দগত ও বানান ভুল থাকার কারণে তা মন্ত্রির অফিস কক্ষেই সংশোধন করা হচ্ছে। ভুলগুলো সংশোধনের পর তার কপি সাংবাদিকদের দেয়া হবে। জানা যায়, গত ৭ই মার্চ মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত নীতিমালার নারী অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত ২৫.২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলাছিল, ভূমিসহ সম্পদ, সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকারে নারীর সমান অধিকার থাকবে বলে ৮ মার্চ দেশে বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত হয়। আর পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে, উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা। (নয়াদিগন্ত ১১ই মার্চ ২০১১ শুক্রবার )
সংবাদপত্রে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনটি দেখেই বলুন, সরল স্বীকারোক্তি বা খোলামেলা ভুল সংশোধনের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও উদারতার পথ পরিহার করে অন্য পথ কি শান্তির? সন্দেহ ও অবিশ্বাস দানা বেধে উঠার মতো বাতাবরণ তৈরি করে যারা সরকারের নৈতিক ভীতকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। যারা জনগণকে বোকা ভাবছেন অথবা জনগণের সামনে আলেম সমাজকে ধূর বানানোর জন্য ঘষামাজা ও চাতুর্যের আশ্রয় নিচ্ছেন, তারা যে সরকারের কতো বড় ক্ষতি করছেন, তা কি তারা জানেন? আন্দোলনরত ধর্মীয় নেত্রীবৃন্দের দাবী অনুযায়ী নারী নীতি ২০১১ সংশোধনই ইতিবাচক চিন্তার পথ। কোন বিষয়ে লুকোচুরী, রাখ-ঢাক, গুড়গুড় বিরোধ নিরসনের উপায় হতে পারে না। যৌক্তিক কারণে সংক্ষুব্ধ নিরীহ নাগরিক ও ধর্মপ্রাণ মানুষকে দমন-পিড়নের ভয় প্রদর্শন শুভ ফল বয়ে আনে না। একটি অসত্ব, ভুল বা অপকৌশলকে ঢাকতে একের পর এক অন্যায় আচরণ মুক্তির পথ নয়। সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান ও ভূমিকায় স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রি গত ১০ মার্চ ২০১১ গণভবনে অনুষ্ঠিত মহাজোটের সংসদীয় দলে সভায় ঘোষণা করেছেন, ‘সরকার কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন করবে না।’ প্রদত্ত এই ঘোষণার আলোকে নারী নীতির বিষয়টি সুন্দর, ও শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য সমাধানে সংশ্লিষ্ট সকল মহল দ্রুত এগিয়ে আসবেন। এটাই ধর্মপ্রাণ কোটি মানুষের প্রত্যাশা।