পরিচিতি

অবস্থান :

রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা মোহাম্মাদপুরের ঐতিহাসিক সাত মসজিদকে বুকে জড়িয়ে বিশাল দেহ-বল্লারী নিয়ে দণ্ডয়মান ঐতিহ্যবাহী জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া।

মুজাহিদে মিল্লাত হযরত শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. এর হাতেগড়া স্বর্ণমানব শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক দা. বা. এক ঝাঁক সাহসী সৈনিক নিয়ে শত বাঁধার প্রাচীর পেরিয়ে নিবেদিত প্রাণ কিছু সহযোগীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া। দুই বৎসর অস্থায়ীভাবে পরিচালিত হওয়ার পর ১৯৮৮ সালে ঐতিহাসিক সাত মসজিদ সংলগ্ন নিজস্ব জায়গায় “জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া” নামে পূর্ণোদ্দমে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়।

আদর্শ

জামিয়া রাহমানিয়া বিশ্ববিখ্যাত মাদারে ইলম দারুল উলূম দেওবন্দের সিলসিলাভুক্ত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আদর্শ ভিত্তিক বৃহত্তর একটি দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

লক্ষ্য  ও উদ্দেশ্য

১. ইলমে দ্বীনের হেফাজত ও ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে আহকামে খোদাওয়ান্দী ও সুন্নাতে নববী প্রতিষ্ঠার লক্ষে নিয়মতান্ত্রিক তালীম ও তারবিয়াতের মাধ্যমে হক্কানী আলেম তৈরী করত তরবিয়াত ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশ ও জাতির খেদমতের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।

২. আকায়েদে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ও ফিকহে হানাফীর সংরক্ষণ এবং দেওবন্দী সিলসিলায়ে তালীম-তরবিয়াতের যথাযথ বাস্তবায়ন করা।

. ইসলামবিদ্বেষী খোদাদ্রোহীদের নিয়মতান্ত্রিক মোকাবেলা পূর্বক সমাজ থেকে নাস্তিক্যবাদ, শিরক ও বিদআতের মূলৎপাটনের মাধ্যমে ইসলাহী তৎপরতা দ্বারা সমাজে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা ও সার্বস্তরে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তন করা।

জামিয়ার শিক্ষাধারা

জামিয়া রাহমানিয়া গতানুগতিক কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম নয়। সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে জামিয়া সাজিয়েছে তার পাঠনদান পদ্ধতি। শিশু শ্রেণী থেকে শুরু করে সবোর্চ্চ দাওরায়ে হাদীস, ইফতা, তাফসীর, উলূমুল হাদীস, ইসলামের ইতিহাস, আরবী ও বাংলা  সাহিত্য সহ বিভিন্নিমূখী পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন করে চতুর্মূখী যোগ্যতাসম্পন্ন বিচক্ষণ আলেমে দ্বীন জতিকে উপহার দেওয়ার সুখ্যাতি ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে গেছে। সুবিন্যস্ত সিলেবাসের ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে  মৌলিকভাবে কুরআন, হাদীস, ফিকাহ, তাফসীর , উসূল, আকায়িদ, বৈষয়িক পর্যায়ে আরবী সাহিত্য , বাংলা সাহিত্য, ব্যাকরণ , নাহু , সরফ , বালাগাত সহ বাংলা, ইংরেজী, গণিত , ইতিহাস ,ইতিহাস, ভূগোল  দর্শন ইত্যাদি সমূদয় বিষয়ে  প্রয়োজন পরিমানে শিক্ষা দেয়া হয়। শিক্ষার পাশাপাশি জনসমাজে ইসলামী শিক্ষার সুফল পৌঁছে দেয়ার মহান লক্ষ্যে জামিয়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে থাকে। সব মিলিয়ে জামিয়া রাহমানিয়া বহু বিভাগ সমন্বিত একটি মহা প্রকল্প।

জামিয়ার শিক্ষা প্রকল্প:

১। মক্তব বিভাগ : মাত্র ২ বৎসরের কোর্সে সহীহ শুদ্ধভাবে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ তিলওয়াত, আমপারা ও অর্থসহ ৪০টি হাদীস মুখস্থ করানো হয়। অত্যাবশ্যকীয় মাসআলা – মাসায়িল সহ প্রাথমিক বাংলা, অংক, ও ইংরেজী শেখানো হয়।

২। হিফজ বিভাগ : মক্তব থেকে আসা ছোট ছোট শিশুদেরকে ৩-৪ বৎসরে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ শুদ্ধরূপে মুখস্থ করানো হয়।

৩। কিতাব বিভাগ : এটি জামিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় সর্বাধিক সমৃদ্ধ, বৃহত্তর ও প্রধান বিভাগ। এ বিভাগেই তৈরী হয় জাতির কাণ্ডারী ও আধ্যাত্মিক রাহবার। দ্বীনী শিক্ষার ক্রমমূল্যায়নের ভিত্তিতে কিতাব বিভাগটি মৌলিক পর্যায়ে পাচটি স্তরে বিভক্ত।

(ক) ইবতিদাইয়্যাহ / প্রাথামিক।

(খ) মুতাওয়াসসিতাহ / মাধ্যমিক

(গ) সানাবিয়্যাহ উলয়া / উচ্চ মাধ্যমিক।

(ঘ) ফযীলত  / ডিগ্রী।

(ঙ) তাকমীল /  মাষ্টার্স।

এ পাচটি স্তরে মোট ১০ বৎসর সময়ে পূর্ণ দ্বীনী শিক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীকে যোগ্য আলেম রূপে গড়ে তোলা হয় ও সনদ প্রদান করা হয়।

৪। ইফতা কোর্স : এ কোর্সের মাধ্যমে দাওরায়ে হাদীস (তাকমীল) শ্রেণীর চূড়ান্ত পরীক্ষায় ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ আলেমদেরকে ফিকাহ স্পেশালিষ্ট হিসাবে যুগ সমস্যার সঠিক সমাধান দিতে যোগ্যতাসম্পন্ন মুফতী রূপে গড়ে তোলা হয়।

৫। তাফসীর কোর্স : এ কোর্সটি দাওরায়ে হাদীস সমাপ্তকারী আলেমদের কুরআনে কারীমের তাফসীর বিষয়ে গভীর জ্ঞান দানের জন্য গবেষনামূলক  একটি প্রশিক্ষণ কোর্স। এ কোর্সের মাধ্যমে একজন আলেমকে তাফসীর শাস্ত্রে পারদর্শী মুফাসসির রূপে গড়ে তোলা হয়।

জামিয়ার ছাত্র প্রশিক্ষণ কর্মসূচী

দ্বীন ও সমাজের সকল পরিসরে জামিয়ার সন্তানরা যাতে ভূমিকা রাখতে পারে, যে জন্য রয়েছে নানামুখী আয়োজন। এসব আয়োজনকে বাস্তব রূপদানের জন্য মেধাবী ছাত্রদেরকে নিয়ে গঠিত হয় ছাত্র সংসদ। যা ‘রাহমানিয়া ছাত্র কাফেলা’ নামে পরিচিত। তাদের দক্ষ পরিচালনায় সম্পন্ন হয় নিম্নোক্ত আয়োজনসমূহ :

(ক) ছাত্র পাঠাগার : জামিয়ার সিলেবাসভুক্ত পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি ছাত্রদের জ্ঞানের পরিসীমা আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে পৌঁছানোর লক্ষ্যে সমকালীন অবস্থা ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট সর্ম্পকে অবগতির জন্য তথ্যবহুল বই-পুস্তক সমৃদ্ধ একটি উঁচু মানের পাঠাগারের ব্যবস্থা রয়েছে।

(খ) বক্তৃতা প্রশিক্ষণ : ইলম অর্জনের পর তা সুন্দর সাবলিল ভাবে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ছাত্র কাফেলা আয়োজন  করে প্রতিযোগিতামূলক সাপ্তাহিক বক্তৃতা প্রশিক্ষণ জলসা।

(গ) দেয়ালিকা : পাশ্চাত্যমুখী বিকৃত রুচির কলম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ইসলামী সাহিত্যের নির্মল জ্যোতি বিকিরণের মহান লক্ষ্য নিয়ে ছাত্রদেরকে কলম সৈনিক রূপে গড়ে তোলা।

জামিয়ার সেবা প্রকল্প :

১। ফতওয়া বিভাগ : ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও বিভিন্ন বিষয়ের শরঈ মাসয়িল ও সমাধান প্রদানের জন্য এ বিভাগ। এ বিভাগ থেকে এ ধরনের যে কোন প্রশ্নের জবাব দক্ষ মুফতীগণ দিয়ে থাকেন।

২। ফারায়েয বিভাগ : মৃত ব্যক্তির পরিত্যাক্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি উত্তারাধীকারদের মাধ্যে শরীয়তের বিধান মোতাবেক সুস্থ বন্টনের রূপরেখা প্রদান করা হয় এ বিভাগের মাধ্যমে।

৩। দাওয়াত ও তাবলীগ : সাধারণ মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত,  তাদেরকে দ্বীন শেখানো ও নিজের আমলী জিন্দেগী গড়ার লক্ষ্যে অসংখ্য ছাত্র প্রতি ছুটিতে সময় লাগানোর জন্য বের হয়। প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত ২৪ ঘন্টা তাবলীগী কর্মসূচী পালন করা হয়। দাওয়াত ও তাবলীগ বিভাগ এ সকল কর্মসূচী যথাযথ বাস্তবায়ন করে থাকে।

৪। মজলিসে দাওয়াতুল হক : হযরত মাও: আবরারুল হক রহ. প্রতিষ্ঠিত মজলিসে দওয়াতুল হকের কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমে আধুনিক শিক্ষিত লোকদেরকে দ্বীনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয় এবং বিদআত ও কুসংস্কারের মুলোৎপাটনে সহীহ সুন্নাতের প্রচার করা হয়।

৫। রচনা ও প্রকাশনা : অধুনা সাহিত্যাঙ্গনগুলো পাশ্চাত্যঘেষা তথাকথিত বুদ্ধীজীবীদের দখলে। নৈতিকতা বিবর্জিত ওদের ঐসব সাহিত্য পড়ে যুব সমাজের চরিত্র হয়েছে কলুষিত। তাই যুব সমাজকে অবক্ষয় থেকে উদ্ধার এবং আপামর বাংলাভাষী মানুষের কাছে ইসলামের অমীয় বাণী পৌঁছে দেওয়ার মহান ব্রতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে জামিয়া রাহমানিয়া। বেশ কিছু সু-সাহিত্যিক, ক্ষুরধার কলম সৈনিক ছাত্র-শিক্ষকের লেখা প্রবন্ধ, নিবদ্ধ ও প্রতিবেদন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। সেই সাথে প্রকাশিত হচ্ছে তাদের গবেষণাধর্মী এবং আরবী/উর্দু/ফারসী ভাষা থেকে অনুদিত বিভিন্ন গ্রন্থাবলী। জামিয়া রাহমানিয়ার একটি সফল প্রকাশনা ‌‌রাহমানী পয়গাম। ইসলামী তাহযীব তামাদ্দুনকে সংরক্ষণ ও যুগের চাহিদা মিটাতে এ ম্যাগাজিনটি ইিতিমধ্যে দেশের সীমানা পেরিয়ে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে পদার্পন করতে সক্ষম হয়েছে।

৬। দুস্থ মানবতার সেবা : জামিয়ার সেচ্ছাসেবী ছাত্র-শিক্ষকগণ লেখা পড়ার পাশাপাশি আর্তমানবতার সেবায় সদা তৎপর। জামিয়ার পার্শ্ববর্তী এলাকার গরীব-দুস্থ ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছাস, নদী ভাঙ্গন ইত্যাদী প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের সেবায় তারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।

৮। মাসিক দ্বীনী আলোচনা সভা : সাধারণ মানুষের দ্বীনী সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি ইংরেজী মাসের প্রথম শুক্রবার বাদ মাগরিব জামিয়া আয়োজন করে থাকে এক দ্বীনী মাহফিলের। এতে নসীহত পেশ করেন জামিয়ার মুহাদ্দিস সহ অন্যান্য উলামায়ে কেরামগণ। মাহফিলের মধ্যমণি থাকেন বরাবরই শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক সাহেব দা. বা.।

জামিয়ার শিক্ষা সফলতা  : প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করার ফলে। অতি অল্প সময়ে এ প্রতিষ্ঠানটির সুনাম-সুখ্যাতি বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। সার্বিক দিক বিবেচনায় এ প্রতিষ্ঠানটি উলামায়ে কেরাম ও সুধী মহলের নিকট ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। অপর দিকে সুদক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর আ্ন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় পরীক্ষাসমূহে বিভিন্ন মারহালায় মেধা তালিকায় সম্মানজক স্থান অধিকার করে ধারাবাহিকভাবে সাফল্য অর্জন করে আসছে।

শেষ কথা : মনোরম আবাসিক পরিবেশে হযরত শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক দা. বা. এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় পরিচালিত এ জামিয়া সাবলীল গতিতে এগিয়ে চলছে তার অভিষ্ঠ লক্ষ্যপানে। দেশ জাতি ও দ্বীনের কল্যানে জামিয়া রাহমানিয়ার কর্মকাণ্ড হোত গতিময় ও সাফল্য মণ্ডিত। আমীন।

Leave a Comment