জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া, সংগ্রামী পথ চলা

শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর জীবন ছিল সংগ্রামী জীবন। সময়ের প্রয়োজনে ইসলাম বিরোধী অপশক্তি, কখনো সরাসরি রাষ্ট্রযন্ত্রের মোকাবেলায় তাঁকে দ্বীন ও উম্মাহর প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়েছিল। আর এ ভূমিকা পালন করতে যেয়ে তাঁর জীবনে বারবার নেমে এসেছিল কারাভোগ। এমনকি নিজের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান থেকেও তাকে বিদায় গ্রহণ করতে হয়েছিল। আপোষহীন সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের কারণেই এ দেশের মানুষের শাইখুল হাদীসের প্রতি ছিল আস্থা ও ভালোবাসা। দ্বীন ও উম্মাহর যে কোন বিপর্যয়ে এদেশের মানুষের দৃষ্টি থাকত শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের ভূমিকার প্রতি। তিনি ছিলেন তৌহিদী জনতার আস্থাশীল নেতৃত্ব।আল্লামা মাহফুজুল হক আল্লামা মামুনুল হক দেশের আলেম সমাজের আস্থার প্রতীক। এদেশের মানুষ ও আলেম সমাজ তাদেরকে শাইখুল হাদিসের যোগ্য উত্তরসূরি মনে করে থাকে। মানুষের ভালোবাসা ও আস্থা থেকেই দেশের ক্রান্তিকালে তাদেরকে ভূমিকা পালন করতে হয় বাবার মতই। বাবার সে সংগ্রামী চেতনা ও বলিষ্ঠ ভূমিকার প্রতিনিধিত্ব করার এই পথ বড় দুর্গম। সময়ের সাহসী রাহবার আমাদের প্রাণ প্রিয় উস্তাদ আল্লামা মামুনুল হকের কারাভোগ তারই প্রমাণ। নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ যখন উত্তপ্ত। প্রতিবাদী মানুষ রাজপথে। দেশ প্রেমিক ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী এই ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে যে কোনো মূল্যে দমনে রাষ্ট্রযন্ত্র যখন বদ্ধপরিকর। অত্যান্ত ন্যাক্কারজনকভাবে দেশব্যাপী সহিংসতার দায়ভার চাপিয়ে দিয়ে আল্লামা মামুনুল হক ও আলেম সমাজকে কারাবন্দি করে সরকার। রাষ্ট্রীয় জুলুমের শিকার হয় শাইখুল হাদিসের রেখে যাওয়া প্রতিষ্ঠান। দ্বীন ও উম্মাহর বিপর্যয়ে দীর্ঘ দুই যুগ ধরে নেতৃত্বদানকারী এ প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিকে নির্মূল করা ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের লক্ষ। সুযোগ-সন্ধানী একটি পক্ষ রাষ্ট্রকে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়়নে সহযোগিতা করে।কঠিন পরিস্থিতিতে দুটি পথ খোলা ছিল। আপোসকামিতা অথবা রাষ্ট্র যন্ত্রের সাথে মোকাবেলা। ধীরস্থিরতার প্রতিক, দেশ ও জাতির অতন্দ্র প্রহরী আল্লামা মাহফুজুল হক তৃতীয় একটি পথ বেছে নিলেন। আদর্শের সাথে বেইমানি করে কোন ধরনের আপসকামিতা নয়, অযথা রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে মোকাবেলা করে শক্তির ক্ষয় নয়। বরং সকল পরিস্থিতির মোকাবেলা করে শাইখুল হাদিসের চেতনার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার প্রত্যয় নিয়ে নতুন নিরাপদ ঠিকানা গড়ে তোলা। ত্যাগের অনুপম দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত করে ৮ জিলহজ্জ ১৪৪২ হি. ১৯ জুলাই ২০২১ ইং সোমবার জামিয়ার সকল উস্তাদ, স্টাফ ও ছাত্রদেরসহ আল্লামা মাহফুজুল হক হাফিযাহুল্লাহ বাবার রেখে যাওয়া ভবন ছেড়ে আসেন। শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যখন তার বান্দা কোন ত্যাগ ও কুরবানীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বান্দা তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগেই আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার কাছে সাহায্য চলে আসে। চলে আসার পূর্ব মধ্য রাতে আল্লামা মাহফুজুল হক যখন জামিয়ার কিছু শিক্ষক এবং ফুযালাদের নিয়ে ভবন ছেড়ে দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। তখনো পর্যন্ত পরবর্তী গন্তব্য জানা ছিল না কারো। তিনি নিজেও জানতেন না ছাত্র-শিক্ষকদের এ বিশাল পরিসর নিয়ে আগামী দিনের ঠিকানা কোথায়। সে বৈঠকেই শাইখুল হাদিসের দৌহিত্র জামিয়ার শিক্ষক মাওলানা আব্দুল্লাহ মারুফ সে কঠিন পরিস্থিতিতে প্রস্তাব পেশ করেন বসিলা ব্রিজ এর পাশে তাদের নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়েই যেন সর্বপ্রথম ওঠা হয়। জামিয়ার নিকটতম প্রতিবেশী, জামিয়ার শিক্ষক-ছাত্রদের সুখ দু:খের সাথী এমদাদ ভাই কিছুদিন আগেই নিজস্ব ভূমিতে হাজী দিলগনী জামে মসজিদ নামে মসজিদ নির্মাণ করেন। ফজরের নামাজের সাথে সাথেই এমদাদ ভাই উপস্থিত। তিনি আবদার করলেন ছাত্র-শিক্ষকসহ আমার মসজিদ কমপ্লেক্স আপনাদের জন্য। আল্লামা মাহফুজুল হক ৮ই জিলহজ্জ শিক্ষক স্টাফ ছাত্রদেরকে সহ ভাগিনা আব্দুল্লাহ মারুফদের বিল্ডিংয়েই প্রথম উঠলেন এবং পরামর্শক্রমে কিছু ছাত্র শিক্ষক হাজী দিলগনী জামে মসজিদে পাঠানো হলোা। সেদিনের মত সকলেই বিশ্রামে চলে গেল।পরদিন ৯ জিলহজ জামিয়ার সকল শিক্ষকদেরকে নিয়ে বৈঠক করলেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ-এর চেতনাকে বুকে ধারণ করে আমাদের পথচলা অব্যাহত থাকবে। সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে আমরা অগ্রসর হবো ইনশাআল্লাহ। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ১০ ই জিলহজ ঈদুল আজহায় মাদ্রাসার গুরাবা তহবিলের জন্য শিক্ষক ছাত্রদের অংশগ্রহনে কুরবানীর চামড়া কালেকশন অব্যাহত রাখা হবে। সামান্য কিছু ছাত্র আর শিক্ষক মাঠে ছিল আর ছিল আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাহায্য। ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে মাদ্রাসার আহ্বান নিয়ে মানুষের কাছে আমরা সীমাহীন ভালোবাসা পেলাম। কৃতজ্ঞতা রাব্বুল আলামিনের দরবারে। তিনিই আমাদের একমাত্র ভরসার কেন্দ্র, সাহায্যস্থল।দীর্ঘ লকডাউন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। দোয়া ও ফিকির চলছিল নানামুখী। প্রতিপক্ষরা বসে ছিল না। আমাদের প্রতি তাদের ছিলো তীক্ষ দৃষ্টি। রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে আমাদের কোথাও বসতে না দেয়াই ছিল তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। আমাদের পরিকল্পনা ছিল আপাতত অস্থায়ী জায়গায় জামিয়ার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা। তারপর স্থায়ী জায়গার ফিকির করা। জনাব এমদাদ ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত হাজী দীলগনি জামে মসজিদকে কেন্দ্র করে কোরবানির ঈদ পরবর্তী সময়ে ২৭/১২/ ১৪৪২ হিঃ ৭/৮/২১ ইং জামিয়ার উপস্থিত- উস্তাদ ছাত্র ও কিছু শুভাকাঙ্খীদের উপস্থিতিতে দোয়ার মাধ্যমে জামিয়ার ইফতা বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর নামকে ধারন করে আল্লামা মাহফুজুল হক হাফিযাহুল্লাহ এর প্রতিষ্ঠিত এ সংগ্রমাী প্রতিষ্ঠানের নাম করণ করা হয় “জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া ” এই নামকে ধারন করেই আগামী দিনে ঐক্য বদ্ধ পথ চলার সিদ্ধান্তে সকলে একমত হন। পরবর্তীতে ১৮/০১/৪৩ হি: ২৮/০৮/২১ইং তারিখ হাজী দিলগনি জামে মসজিদকে কেন্দ্র করে হিফজ বিভাগের কার্যক্রমও শুরু করা হয়। এই প্রতিকূল সময়ে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন বসিলা অঞ্চলের বিশিষ্ট সমাজ সেবক জনাব জিয়াউর রহমান। প্রথমত নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রায় ৮ কাঠা জায়গার উপর স্থাপিত ওয়ার্কশপকে জামিয়ার শিক্ষার্থীদের মাল-সামানা রাখার জন্য তিনি ব্যবস্থা করে দেন। বসিলা সিটি ডেভলপার্স ও সূচনা মডেল টাউন হাউজিং-এ প্রায় ৩০/৩৫ কাঠা জায়গার উপর জামিয়ার অস্থায়ী স্থাপনা তৈরীর উদ্যোগ নেয়া হয়। বসিলা নিবাসী বিশিষ্ট সমাজ-সেবক ব্যবসায়ী জনাব আলহাজ্ব আব্দুর রশীদ তালুকদারের ব্যবস্থাপনায় মাটি ভরাট ও পানি ব্যবস্থাপনার কাজ শুরু করার পর মুহুর্র্তে প্রশাসনিক ও প্রতিপক্ষের বাধা আসে। প্রশাসন ও প্রতিপক্ষের বাধার মুখে এ অস্থায়ী কার্যক্রমের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। কঠিন দু:সময়ে জনাব আলহাজ আব্দুর রশীদ তালুকদার , জনাব এম, এস আহমদ আলী ও জনাব জিয়াউর রহমান ও আরো কিছু মানুষের সাহসী ভূমিকা আমাদের শক্তি যুগায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে উত্তম বিনিময় দান করুন!এ পর্যায়ে জনাব জিয়াউর রহমান বসিলা গার্ডেন সিটির ৪০ ফিট রাস্তার পশ্চিম প্রান্তে নদীর তীর সংলগ্ন নিজ পাঁচ কাঠা জায়গা জামিয়ার অস্থায়ী কার্যক্রমের জন্য হস্তান্তর করেন। সেখানে টিনশেড ঘর তৈরির কার্যক্রম শুরু হয়। মিস্ত্রিসহ টিনশেড ঘর তৈরির যাবতীয় সরঞ্জাম টাংগাইল মির্জাপুর থেকে নিয়ে আসা হয়। মিস্ত্রিদের সাথে জামিয়ার শিক্ষক, ফুযালা ও শিক্ষার্থীদের অদম্য পরিশ্রমে দ্রæত সময়ের মাঝেই ঘর তৈরির কাজ শেষ হয়। জামিয়ার এ টিনশেড ঘর তৈরীর কাজে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকার আলেম-ওলামা ও সাধারণ মানুষদের ছুটে আসা ছিল আমাদের জন্য বিশাল এক পাওয়া। অনেক বয়োবৃদ্ধ আলেমরা প্রচন্ড গরমেও জামিয়াকে গড়ে তোলার কাজে অংশগ্রহণ করেন। জামিয়ার এই ঘর নির্মাণ কাজে জামিয়ার শিক্ষক মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক-এর ভুমিকা ছিল অসামান্য। এরই মাঝে সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন জামিয়ার দুই ফুযালা মাওলানা নুরুজ্জামান ও মাওলানা ইয়াহইয়া। পাশেই নিজস্ব ভূমিতে নির্মাণাধীন নয়তলা বিল্ডিং এর চতুর্থ তলা পর্যন্ত জামিয়ার অস্থায়ী শিক্ষা কার্যক্রম চালুর ব্যবস্থা করে দেন। ০৪/০২/৪৩হি. ১২/৯/২১ ইং দীর্ঘ লকডাউনের পর সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়। ঠিক সেইদিন অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর সাথেই জনাব জিয়াউর রহমান সাহেবের পাঁচ কাঠা জায়গায় গড়ে উঠা টিনশেড ঘর দারে আবু বকর, এবং তারই ওয়ার্কসব ও বিল্ডিংকে কেন্দ্র করে জামিয়ার কিতাব বিভাগের আংশিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। ইবতেদায়ী আউয়াল থেকে সানুভী আওয়াল শরহে জামী পর্যন্ত জামাত গুলো প্রাথমিকভাবে খোলা হয়। একই দিনে হাজী দিলগণি জামে মসজিদকে কেন্দ্র করে নূরানী ও নাজেরা বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রমও শুরু হয়।এরই মাঝে জামিয়ার ফুযালা বিশিষ্ট আলেম, ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহর জিম্মাদারীতে ছয় কাঠার আরেকটি প্লট জামিয়ার অস্থায়ী কার্যক্রমের জন্য ব্যবস্থা হয়। জামিয়ার শিক্ষক ছাত্র শুভাকাক্সক্ষীদের পরিশ্রম ও তৎপরতায় দ্রæত সময়ে টিনশেডের কাজ সমাপ্ত হয়। ১৭/২/৪৩ হি. ২৫/৯/২১ইং দ্বিতীয় টিনশেড দারে উমরে দাওরা ও মেশকাত জামাতের শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। শরহে বেকায়া ও জালালাইন জামাতের ছাত্রদের শিক্ষা কার্যক্রম তখনও চালু করা সম্ভব হয়নি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাহায্য নিয়ে আমরা ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছিলাম। দোয়া ফিকির পরিশ্রম একই সাথে চলছিল। এরই মাঝে নতুন পাঁচ কাঠার আরেকটি প্লট অস্থায়ী কার্যক্রমের জন্য আমরা পেয়ে যাই লালমাটিয়া মাদ্রাসার কিছু শিক্ষকদের তরফ থেকে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের এ অবদানকে কবুল করুন।নতুন প্লটের তথ্য জানার সাথে সাথেই শিক্ষার্থীরা উপস্থিত। মিস্ত্রি ও শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দুই সপ্তাহের মাঝেই টিনশেড তৈরীর কার্যক্রম সমাপ্ত হয়। ০৫/০৩/৪৩ হিঃ ১৩/১০/২১ইং তৃতীয় টিনশেড দারে উসমানে শরহে বেকায়া ও জালালাইনের ক্লাস শুরুর মাধ্যমে জামিয়ার সকল বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। প্রায় ৯০০ ছাত্র অর্ধ শতকেরও বেশি শিক্ষক ও স্টাফ নিয়ে বর্তমানে জামিয়ার শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানের সূচনা করাই যাদের জন্য ছিল একরকম অসম্ভব আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের খাস মেহেরবানীতে আজ প্রথম বছরের শিক্ষা কার্যক্রমের আমরা শেষ প্রান্তে উপনীত। এই পরিস্থিতির মাঝেও নিচের জামাত গুলোর নিয়মিত মাসিক পরীক্ষা ও সকল ছাত্রদের অংশগ্রহণে ব্যাপক প্রস্তুতির সাথে অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষার কার্যক্রমও সুন্দরভাবে শেষ হয়। নিয়মিত শিক্ষকদের সাপ্তাহিক মিটিং, সাপ্তাহিক তরবিয়তী আলোচনাকে আরো বেগবান করা হয়। নিয়ম তান্ত্রিক শিক্ষাধারার সাথে সাথে জামিয়ার শিক্ষার্থীদের বহুমুখী মেধার বিকাশে জামিয়ার ছাত্র কাফেলার কার্যক্রম এ বছর ছিল অনেক প্রাণবন্ত। সাপ্তাহিক ও এজতেমায়ী বক্তৃতা অনুষ্ঠান ও বার্ষিক প্রতিযোগিতায় ছাত্রদের অংশগ্রহন ও প্রস্তুতি ছিল নজরকাড়া। জামিয়ার সবক উদ্বোধনের প্রথম দিন আল্লামা মাহফুজুল হক উপস্থিত ছাত্র-শিক্ষক ও শুভাকাক্সক্ষীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “আমাদের কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যে পরীক্ষা আমাদের থেকে নিচ্ছেন আমরা তারই তাওফিকে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর পুরস্কার এর ব্যাপারে আশাবাদী।” বছরের সেই শুভ সূচনার দিন থেকে বছরের এ সুন্দর সমাপ্তি পর্যন্ত আমরা প্রতি মুহূর্ত আল্লাহর সাহায্য ও নুসরত দেখছি। ইতিমধ্যে বসিলার অধিবাসী জামিয়ার অন্যতম শুভাকাক্সক্ষী হাজী ইউনুস সাহেব, জনাব আলহাজ আব্দুল হাকীম গং ও জনাব আমানুল্লাহ সাহেবের নতুন ১১ কাঠা জায়গায় চতুর্থ টিনশেড দারে আলী তৈরীর কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। আমাদের পরিকল্পনা জামিয়ার ভবিষ্যত স্থায়ী ক্যম্পাস ইনশাআল্লাহ বসিলা অঞ্চলকে কেন্দ্র করেই হবে। সেই লক্ষকেই সামনে রেখে স্থায়ী ক্যম্পাসের জায়গা ক্রয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক জায়নামাজ সমপরিমাণ ভূমি ৫০০০০ টাকা , দুই জায়নামাজ সমপরিমাণ ভূমি ১০০০০০ টাকা অনুদানের ভিত্তিতে জামিয়ার জমিদাতা আজীবন সদস্য সংগ্রহ শুরু হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জামিয়ার অভিভাবক। জামিয়ার হাজারো ফুযালা ও সুভাকাঙ্খিদের ভালোবাসাই জামিয়ার সম্বল।জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠান নয়। এটি এক আদর্শ, এক চেতনার নাম। এই প্রতিষ্ঠানের হাজারো সুভাকাঙ্খী দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে। দ্বীন ও উম্মাহর বিপর্যয়ে শাইখুল হাদিসের আদর্শিক ধারা এই প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সকলের ভালোবাসায় টিকে থাকবে ইনশাআল্লাহ। রাহমানিয়া ছাত্র কাফেলার বিদায় অনুষ্ঠানে আল্লামা মাহফুজুল হক সকলকে লক্ষ্য করে বলেন “প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানের সূচনাই আমাদের জন্য একরকম অসম্ভব ছিল কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সীমাহীন মেহেরবানি আমরা আজ বিদায়ী অনুষ্ঠান করছি।” তিনি শুকরিয়া আদায় করেন জামিয়ার সমস্ত শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও স্টাফদের যারা সাহস নিয়ে জামিয়ার কঠিন সময়ে জামিয়াকে নতুনভাবে গড়ে তোলায় শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে জামিয়ার নাজেমে তা’লীমাত মুফতি আশরাফুজ্জামান হাফিজাহুল্লাহর অবদান, দীর্ঘ ৩৮ বছর একসাথে পথ চলার স্মৃতি তুলে ধরে তিনি তার শুকরিয়া আদায় করেন। জামিয়া রহমানিয়া ও শাইখুল হাদীসের ত্যাগ কুরবানীর মাঝে জড়িয়ে থাকা একনাম মুফতি আশরাফুজ্জামান। ২০০০ সালে মজলুম শাইখুল হাদিসকে কেন্দ্র করে জামিয়া রাহমানিয়া হাকিকিয়া গড়ে তোলার পিছনে তিনি ছিলেন অন্যতম কারিগর। ২০২১ সালে আবারও নতুন করে জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া গড়ে তোলার পিছনে তিনিই আল্লামা মাহফুজুল হকের পাশে থাকা জামিয়ার শিক্ষার্থীদের প্রধান অভিভাবক। জামিয়ার শিক্ষার্থীদের তালিম তারবিয়াত, নেযাম ও শিক্ষা সফলতায় আল্লামা আশরাফুজ্জামান হাফিজাহুল্লাহ এর নিরলস প্রচেষ্টা তুলনাহীন। জামিয়ার প্রতিটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে তার সোহবত ও সান্নিধ্য বিশেষ এক নেয়ামত। শত প্রতিক‚লতার মাঝে তিনি যখন সামনে থাকেন দুর্গম চলার পথও সহজ হয়ে যায়। আাল্লাহর কাছে প্রার্থনা তার প্রতি ভালোবাসা তিনি যেন আরও বাড়িয়ে দেন। আমরা আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ একজন মুফতি আশরাফুজ্জামান আমাদের অভিভাবক।জামিয়ার মুরুব্বী আসাতিযা- শাইখুল হাদিস আল্লামা বাহাউদ্দিন গাজীপুরী, জামিয়ার প্রধান মুফতি আল্লামা হিফজুর রহমান, উস্তাযুল আসাতিযা আল্লামা ইসহাক চাটগামীর জামিয়ার এ দু:সময়ে আন্তরিকতাপূর্ণ অভিভাবকত্ব আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানী। সেই সাথে জামিয়ার মুহাদ্দিস মাওলালা লিয়াকত আলী ও মাওলানা শফিকুল ইসলাম সাহেবের এ দু:সময়ে ত্যাগী অবস্থানের কাছে জামিয়া কৃতজ্ঞ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের হায়াতে বরকত দান করুন। তাদের এলেম দ্বারা আমাদের উপকৃত করুন। প্রিয় উস্তাদ আল্লামা মামুনুল হক কারাগারে। শাইখুল হাদিসের দৌহিত্র জামিয়ার উস্তাদ মাওলানা এহসানুল হক কারাগারে। ‌তাদের শূন্যতা জামিয়ার শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল অনেক কষ্টকর। আমরা আশাবাদী তারা আরো শক্তিশালী হয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসবেন। আমরা মনে করি মজলুম ও নির্যাতিত অবস্থায় তাদের দোয়া আমাদের চলার পথকে সহজ করে দিয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দ্রুত তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করুন। রাব্বুল আলামীনের দরবারে আমাদের সীমাহীন শুকরিয়া আল্লামা মাহফুজুল হক হাফিজাহুল্লাহ আমাদের রাহবার। দীর্ঘ ২০ বছর ইহতেমামের জিম্মাদারী পালনের পর বাবার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান থেকে তার হাসিমুখে বের হয়ে আসা এক দৃষ্টান্ত।আল্লামা মাহফুজুল হক এক অন্যন্য ব্যক্তিত্ব তিনি তার সহকর্মীদের মাঝেও কুরবানির জযবা তৈরি করেছেন। এ প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতেও তার সহকর্মী ও শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ। তার নসিহত ছিল তার সকল সহকর্মিদের প্রতি – “এটা আমাদের জন্য আনন্দের এবং কৃতজ্ঞতার । আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের মত নগন্যদের থেকে কুরবানী নিচ্ছেন। ”জিলহজের ৮ তারিখ বাবার প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওযার সময় তার বিদায়ী উক্তি ছিল “জিলহজ মাস কুরবানীর ইতিহাস বিজরিত মাস। আজ হজ্ব পালনকারী আল্লাহর প্রিয় বান্দারা আরাফায় অবস্থান করছেন। ঠিক সেই সময়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের থেকেও কুরবানি নিচ্ছেন। আমরা আনন্দের সাথে দ্বীনের স্বার্থে হাসি মুখে এ কুরবানি দিতে পেরে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি। আল্লাহ আমাদের সহায়।”তিনি আমাদেরকে বিশেষভাবে সাবধান করেছেন “আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিপক্ষ দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমে দ্বীন এবং আমাদের উস্তাদ, তোমাদের পক্ষ থেকে এমন কোন কথা যেন কিছুতেই না লেখা হয় যার মাধ্যমে আলেম সমাজের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং আমাদের উস্তাদদের প্রতি কোন ধরনের বেয়াদবি হয়।”প্রশাসন থেকে তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল ভবন খালি করে দিতে। কিন্তু উস্তাদ ও প্রতিষ্ঠানে থাকা ছাত্রদের প্রতি তার দিক নির্দেশনা ছিল “ব্যক্তিগত সামানগুলোও যেন পরবর্তীতে অনুমতি সাপেক্ষে বের করা হয়। প্রতিষ্ঠানের কোন সামান যেন বের করা না হয়।”প্রতিষ্ঠানের ক্যাশের যিম্মাদার মাওলানা আবু বকর সাহেব এর প্রতি তার নির্দেশনা ছিল “জামিয়ার আয় ব্যয়ের হিসাব যেন ক্লিয়ার থাকে।” জিলহজ মাস চলছিল। ঈদুল আযহার মাস হওয়ার কারণে সাধারণত শিক্ষকরা এ মাসে ছুটির আগেই তাদের ওযিফা নেওয়ার সুযোগ পেতেন। একপর্যায়ে মাওলানা আবু বকর সাহেব শিক্ষক ও স্টাফদের জিলহজ মাসের ওযিফা দেয়ার অনুমতি চাইলে তিনি জবাব দেন “জিলহজ মাস তো শেষ হয়নি। এই তহবিল থেকে বেতন দেওয়ার সুযোগ নেই” প্রতিষ্ঠান থেকে চলে আসার সময় শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানের ক্যাশেই ছিল ১২ লক্ষাধিক টাকা এবং ব্যাংকে ছিল ৪০ লক্ষাধিক টাকা। অনেকের ভাষায় তিনি বোকামি করেছেন। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে বিশ্বস্ততা ও নৈতিকতার ময়দানে এটা ছিল আল্লামা মাহফুজুল হক হাফিযাহুল্লাহ্ -এর বিজয়।আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিপক্ষের কিছু অন্যায় অভিযোগের জবাব দেয়ার অনুমতি চাইলে তিনি আমাকে বলেন-“ধৈর্য ধরো আল্লাহ খুশি হবেন। আর তোমাদের জবাব দেয়ার মাধ্যমে ইসলাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সাধারণ মানুষ আলেমদের ব্যাপারে মন্দ কিছু জানবে।”সান্তনা দিয়ে তিনি বলেন -“আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যতদিন কবুল করেছেন আমরা এ প্রতিষ্ঠানে খেদমতে নিয়োজিত ছিলাম। আল্লাহর জমিন প্রশস্ত। আমরা ইসলামের জন্য কাজ করে যাব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেখানেই সুযোগ প্রদান করেন।”জামিয়া রহমানিযা আজিজিয়া আল্লামা মাহফুজুল হক হাফিযাহুল্লাহর প্রতিষ্ঠিত সংগ্রামী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান থেকেই আগামী দিনের দ্বীন বিজয়ের সাহসী সন্তানেরা তৈরি হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জামিয়ার আগামী দিনের পথচলা সহজ করে দিন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সাহায্য আরো বাড়িয়ে দিন।

# লেখক : মাওলানা সাঈদ আহমাদ